মানুষের মুখে হাসি ফোটানো শুধু ইসলামিক দৃষ্টিকোণেই মহৎ নয় বরং ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে মানুষকে সামান্য আনন্দ, প্রশান্তি দিলে নিজের কাছেও তা ফিরে আসে। এটাই পৃথিবীর রীতি।
‘Better Than Good: Creating A Life You Can’t Wait To Live’ – নামক একটি বইয়ে খুব সুন্দর একটি কথা লেখা আছে,
” Life is an echo. What you send out, comes back. What you sow, you reap.”
– Zig Ziglar
অর্থাৎ জীবন একটি প্রতিধ্বনি। যা তাকে দেয়া হবে তাই ফিরে আসবে। সেটা সুখ হতে, পারে দুঃখ হতে পারে। মানুষের মুখের হাসি শুধু প্রশান্তি বয়ে আনে না, আর বড় একটা জিনিশ দেয়। দোয়া, আশীর্বাদ বলে কিছু সুন্দর শব্দ আছে। যা আসে মানুষের কর্ম থেকে।
বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬ জন। বাংলাদেশে সব মিলিয়ে ৩ কোটি ৯৩ লাখ ২৯ হাজার পরিবার আছে। যার মধ্যে সবচেয়ে গরিব ৫ শতাংশ বা ১৯ লাখ ৭২ হাজার ৩২টি পরিবার রয়েছে । এই দরিদ্র শ্রেণির প্রতি পরিবারের মাসিক গড় আয় ৭৪৬ টাকা।
তাদের মধ্য থেকে বাংলাদেশের চা বাগানে ৩,০০,০০০ অধিক বাগানি কর্মরত আছে। আগস্টের ৯ তারিখ থেকে দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে বাংলাদেশের চা বাগানগুলোর প্রায় দেড় লাখ শ্রমিক। প্রথমে প্রতিদিন দুই ঘণ্টা করে কর্মবিরতি পালন করলেও, ১৩ই অগাস্ট থেকে তাঁরা অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট শুরু করেন। এরপর দেশের ১৬৮টি বাগানে (ফাঁড়ি চা বাগানসহ ২৩২টি) ছড়িয়ে পড়েছিল এ আন্দোলন। চা শ্রমিকরা তাঁদের দৈনিক কাজ বন্ধ রেখে রাজপথে নেমে সড়ক অবরোধ, মানববন্ধন, বিক্ষোভ সমাবেশ করেন। স্থানীয় প্রশাসন ও শ্রম অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের চা শ্রমিক নেতাদের বৈঠকের পর ২৫ টাকা বাড়িয়ে ১৪৫ টাকা দৈনিক মজুরি ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু শ্রমিকদের একটি অংশ তাতে ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলেও বেশিরভাগ শ্রমিক তাতে রাজি হননি। সাধারণ শ্রমিকদের চাপে ধর্মঘট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে বাধ্য হন চা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ।
অতঃপর বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশনের দশ সদস্যের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠকের পর শনিবার ২৭ই আগস্ট মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চা শ্রমিকদের নতুন মজুরী ১৭০ টাকা ঘোষণা করেন। এর আগে শ্রমিকরা ১২০ টাকা দৈনিক মজুরি পেতেন। ফলে তাদের দৈনিক মজুরি বাড়ল ৫০ টাকা। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব আহমেদ কায়কাউস বলেন, শ্রমিকদের আবাসন, রেশনসহ অন্যান্য যেসব সুযোগসুবিধা দেয়া হয়, তার সঙ্গে এই দৈনিক মজুরি মিলিয়ে তাদের প্রতিদিনের আয় ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা হবে। এর সঙ্গে আনুপাতিকহারে শ্রমিকদের বোনাস, বার্ষিক ছুটি ভাতা, বেতনসহ উৎসব ভাতা, অসুস্থতাজনিত ভাতা ইত্যাদিও বাড়বে বলে তিনি জানান।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নিপেন পাল বলেন, ” প্রধানমন্ত্রী দৈনিক মজুরি ১৭০ টাকা ঠিক করে দেওয়ার পর আমরা বাগানের পঞ্চায়েত কমিটি নিয়ে বসেছি। এতে কারো কোনো আপত্তি নেই। প্রধানমন্ত্রীর এ সিদ্ধান্তে চা শ্রমিকরা সবাই খুশি। সবার একটাই প্রত্যাশা ছিল প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে কিছু শোনার। তিনি মজুরি যা নির্ধারণ করে দেবেন শ্রমিকরা তা মেনে নেবে। আমরা মেনেও নিয়েছি। প্রত্যেক ভ্যালিতে মিটিং হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত সানন্দে মেনে নেওয়ার কথা জানিয়ে দিয়ে এসেছি। আমরা দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় যা করতে পারতাম না, তা করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ধর্মঘট প্রত্যাহার করে চা-শ্রমিকরা কাজে যোগ দেওয়ার জন্য আমরা ভ্যালির সব নেতাদের বলেছি। “
মাত্র পঞ্চাশ টাকা বৃদ্ধির ফলে চা শ্রমিকদের মুখে কতো সুন্দর হাসি ফুটে উঠেছে। তাঁরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখ থেকে কিছু শোনার কি তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এই চা শ্রমিকদের আন্দোলন ছিলো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মুখে কিছু কথা শুনে চা শ্রমিকদের আনন্দের কোন বাঁধ নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কতোটা আস্থা, কতোটা বিশ্বাস, কতোটা সম্মানবোধ আছে বাংলার শ্রমিকদের ভেতর তা এইখানেই বোঝা যায়। তাঁরা মেনেছে দেশের প্রধানমন্ত্রীর কথা। এই পর্যায়ে একটা সুন্দর অতিতের একটি দৃশ্য ভাসমান হয়, বাংলার জনগন পরাধীন রাষ্ট্রের জননেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপর অগাধ বিশ্বাস এবং ভালবাসা রেখেছিলো। সেই বিশ্বাস রক্ষার্থে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজের জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। একই বিশ্বাস আজ বাংলার হতদরিদ্র জনগন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার জন্য রাখছে, এবং সেই বিশ্বাস রক্ষার দায়িত্ব তাঁর।
বাংলাদেশের অধিকাংশ পরিবার মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং দরিদ্র। পাহাড় ছোঁয়া দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মত এই দুর্যোগে সব থেকে বেশি কষ্ট পোহাতে হয় বাংলাদেশের দরিদ্র পরিবারগুলোকেই। মরতে হয় না খেয়ে। এদের মধ্যে কৃষক, শ্রমিক, জেলে বেশি। কর্মজীবী এই মানুষগুলোর শারীরিক পরিশ্রম অন্যান্যদের তুলনায় অনেক বেশি কিন্তু তাদের উপার্জন অনেক কম। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে এই দরিদ্র মানুষগুলোর জীবনে কাল নেমে এসেছে।
ধনীরা ধনী হচ্ছে, আর দরিদ্ররা আরো দরিদ্র। দরিদ্রদের চাওয়া পাওয়া খুব সামান্য এবং স্বাভাবিক। তাঁদের মধ্যে বিলাসিতা নেই শুধুমাত্র মানুষ হিসেবে নিজেদের মৌলিক চাহিদাগুলো সম্পূর্ণরূপে মেটানোই তাঁদের স্বপ্ন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চা শ্রমিকদের জন্য যে সিদ্ধান নিয়েছেন তাতেই চা শ্রমিকরা যত খুশি হয়েছেন, তততাই আশীর্বাদ, দোয়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঝুলিতে জমা হয়েছে। এই ছোট একটা সিদ্ধান্ত মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মনে প্রশান্তি বয়ে আনবে। যতদিন চা শ্রমিকগুলো বেঁচে থাকবেন, ততদিন তাঁরা এই কথাটা মনে করবেন। মাদার তেরেসা একটা কথা বলেছিলেন,
” One should always remember that the actual peace always begins with the smile. It not only brings peace within you but also in this world. ” – said by Mother Teresa
বাংলাদেশের প্রতিটা কৃষক,জেলে, কুমার, কামার, শ্রমিকদের মত দরিদ্র মানুষগুলোর মুখে একইভাবে যদি হাসি ফোটানো সম্ভব হয়, তাহলে বাংলাদেশের মানুষের দুঃখ অনেকাংশ কমে যাবে। ধনীরা, শিক্ষিতরা অর্থ উপার্জন করার নানান কৌশল খুঁজে নিতে পারবে, কিন্তু আমাদের এই দরিদ্র মানুষগুলো শুধু জানে শারীরিক পরিশ্রম দিতে। তাঁদের উন্নতির জন্য কোন গবেষক, কোন পরামর্শক আসবে না। তাঁদের জীবন আগামী ২০/২৫ বছরেও একই অবস্থায় থাকবে। তাঁদের জন্য কেউ কিচ্ছুই করবে না। তাঁদের নামে অনেকেই নিজেদের কর্ম গুছিয়ে নিয়ে যাবে কিন্তু তাঁদের দেবে না। তাঁদের জন্য কিছু করতে হলে সরকারকেই করতে হবে, প্রধানমন্ত্রীকেই করতে হবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ” মুজিববর্ষে গৃহহীন মানুষকে সরকারের সচিবগণের গৃহ উপহার’ কার্যক্রমের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বলেছিলেন,
” জাতির পিতার সারা জীবনের যে সংগ্রাম সেই সংগ্রামের মূল লক্ষ্য ছিল, তিনি সবসময় এটাই বলতেন, তিনি দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চান। আজকে এই একটা ঘর দেয়ার পর সেই দুঃখী মানুষের মুখে যখন হাসি ফোটে, তখন তার যে আনন্দ আসে, আমার মনে হয় এটাই সবথেকে বড় পাওয়া’।
তিনি আরো বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দুঃখী মানুষের জন্য কাঁদতেন। আজ তারই পদাঙ্ক অনুসরণ করে আমরা এই দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবার চেষ্টা করে যাচ্ছি। তিনি আমাদের স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন এবং আমাদের আত্মপরিচয়ের সুযোগ দিয়ে গেছেন।’
বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ভাষ্যগুলোর দিকে আলোড়ন ফেলে দরিদ্র মানুষদের পাশে দাঁড়িয়ে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কথা বিবেচনা করে তাঁদের জন্য, তাঁদের মুখে হাসি ফোটানর লক্ষ্যে কিছু সিদ্ধান্ত নেয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি। এই দরিদ্র পরিবারগুলোর হাসি, বাংলাদেশের উন্নতির জাদুকরী কারণ হয়ে দাঁড়াবে ভবিষ্যতে।
দুরন্ত প্রতিনিধি, লামিসা সানজানা