খেলাধুলা

‘মিউনিখ ট্রাজেডি’কিংবদন্তি ববি চার্লটন

ইংলিশ ফুটবলে কোনোকালেই তারকার অভাব ছিল না। যুগে যুগে তারকার জন্ম দিয়েছে তারা। আধুনিক ফুটবলের উৎপত্তিস্থল    ও বলা হয় ইংলিশদের। কিন্তু সেই দেশই কিনা বিশ্বকাপ জিতেছে মাত্র একবার।

১৯৬৬ বিশ্বকাপের সেই আসরে ইংলিশদের দলে ছিলেন একাধিক তারকা। গর্ডন ব্যাংকস, জিওফ হার্স্ট, রজার হান্ট, নবি স্টিল, ববি মুরের মতো কিংবদন্তিরা ছিলেন। কিন্তু সবাইকে ছাপিয়ে সব আলো কেড়ে নিয়েছিলেন একজন। তিনি ববি চার্লটন।
সেমিফাইনালে পর্তুগালের বিপক্ষে তাঁর জোড়া গোলেই ফাইনালে পৌঁছে গিয়েছিল ইংল্যান্ড। সবমিলিয়ে তিন গোল করে ইংলিশদের বিশ্বকাপ জয়ের অন্যতম কারিগর ছিলেন। সেই চার্লটন অবশেষে ৮৬ বছর বয়সে এসে থামলেন। 

ফুটবল ব্যাকগ্রাউন্ডের পরিবারের জন্ম ববি চার্লটনের।

তার চার মামা ছিলেন পেশাদার ফুটবলার। তাঁর ভাই জ্যাক চার্লটন ছিলেন ফুটবলার। ৬৬-এর বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য ছিলেন তিনি। কিন্তু ববি চার্লটনের ফুটবলে আসার গল্পটা কাকতালীয় বলা যায়। ১৯৫৩ সালে চার্লটনের বয়স তখন মাত্র ১৬, নর্দামবারল্যান্ড স্কুলে ফুটবল খেলছিলেন তিনি।
কোনো পেশাদার ম্যাচ ছিল না এটা। স্কুলে বন্ধুদের সঙ্গে খেলছিলেন তিনি। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের চিফ স্কাউট। চার্লটনের খেলার ধরণ ওই স্কাউটের মনে ধরে। এরপরেই সুযোগ মেলে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের একাডেমিতে। সেখানে চার বছর কাটিয়ে মাত্র ১৯ বছর বয়সে রেড ডেভিলদের জার্সিয়ে সিনিয়র পর্যায়ে অভিষেক হয় তাঁর। ১৯৫৬-৫৭ মৌসুমে ক্যারিয়ারের প্রথম বছরেই ম্যানইউর জার্সিতে ১৭ ম্যাচে গোল করেছিলেন ১২টি। সেই যে শুরু, এরপর আর পিছে তাকাতে হয়নি তাকে।

পরের বছরে চার্লটন দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে যান। কিন্তু ওই বছরই ঘটে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। উরোপিয়ান কাপের কোয়ার্টার ফাইনাল রেড স্টার বেলগ্রেডকে হারিয়ে ম্যানচেস্টারে ফিরছিল দল। বিমান তেল নেওয়ার জন্য মিউনিখে দাঁড়ালে এরপরই বৈরী আবহাওয়ার জন্য ঘটে দূর্ঘটনা। যার নাম দেওয়া হয় ঐতিহাসিক ‘মিউনিখ ট্রাজেডি’। এই দুর্ঘটনায় ৪৪ জন বিমান আরোহীর ২৩ জনই মারা যান, যার মধ্যে ছিলেন ৮ জন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে ফুটবলার। তবে বেঁচে যান তরুণ ববি চার্লটন। মিউনিখ ট্রাজেডিতে বেঁচে যাওয়া সর্বশেষ ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড খেলোয়াড় ছিলেন তিনিই। সেই চার্লটনও পরপারে পাড়ি জমালেন।

দলের আট ফুটবলার হারিয়ে অনেকটা শক্তি হারিয়ে ফেলে ম্যানইউ। কিন্তু দলকে সেরা অবস্থানে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব নেন ম্যাট বাসবি। আর সেই পরিকল্পনার অন্যতম একজন ছিলেন ববি চার্লটন। মিউনিখ ট্রাজেডির পর পুরোনো ছন্দে ফিরতে বেশ সময় লাগে ইউনাইটেডের। পাঁচ বছরের অপেক্ষা কাটিয়ে ১৯৬২-৬৩ মৌসুমে প্রথম শিরোপা জিতে ম্যানইউ। দুই মৌসুম পরে জেতে লিগ শিরোপাও। এরই মধ্যে ইংল্যান্ড জাতীয় দলেও অন্যতম হয়ে ওঠেন চার্লটন। ১৯৫৮ ও ১৯৬২ বিশ্বকাপে খেললেও দলকে শিরোপা জেতাতে পারেননি। অবশেষে ১৯৬৬ সালে এসে সেই অপেক্ষা ফুরাতে রাখেন দারুণ অবদান। যেটা লেখার শুরুতেই বলা হয়েছে। বিশ্বকাপে দুর্দান্ত নৈপুন্যের কারণে জেতেন ব্যালন ডি’অর পুরস্কার। ইংল্যান্ডকে বিশ্বকাপ জেতানোর দুই বছর পর ম্যানইউকে জেতান ইউরোপিয়ান কাপের শিরোপা। যা এখন চ্যাম্পিয়নস লিগ হিসেবে বিবেচিত হয়। ওয়েম্বলিতে বেনফিকার বিপক্ষে ফাইনালে ২ গোল করে রেখেছিলেন অনবদ্য অবদান।

১৯৭০ সালের জাতীয় দলের ক্যারিয়ারের ইতি টানেন চার্লটন। তাঁর করা ৪৯ গোল এখনো ইংল্যান্ডের ইতিহাসে তৃতীয় সর্বোচ্চ। আর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে সবশেষ ১৯৭২-৭৩ মৌসুমে খেলেছেন ববি চার্লটন। রেড ডেভিল জার্সিতে ১৭ বছরের ক্যারিয়ারে ৭৫৮ ম্যাচ খেলে করেছেন ২৪৯ গোল। যা এখনো দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ২৫৩ গোল নিয়ে শীর্ষে ওয়েইন রুনি। ম্যানইউর হয়ে ইউরোপিয়ান কাপসহ তিনটি লিগ ও একটি এফএ কাপ জিতেছেন চার্লটন। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ছাড়ার পর প্রেস্টন নর্থ এন্ড-এর হয়ে ২ বছর প্লেয়ার কাম ম্যানেজার হয়ে কাটিয়েছেন তিনি। আইরিশ ক্লাব ওয়াটারফোর্ড এর হয়ে এক মৌসুম খেলার পর ১৯৭৬ সালে দীর্ঘ ২০ বছরের খেলোয়াড়ি জীবনের ইতি টানেন তিনি। খেলোয়াড়ি জীবনের পর কোচিং পেশার খুব বেশি দিন ছিলেন না তিনি। ১৯৯৬ সালে খেলোয়াড়ি জীবনে তার অবদানের জন্য ব্রিটেনের রাণীর কাছ থেকে ‘নাইটহুড’ উপাধি পান তিনি, এতে তার নামের পূর্বে যুক্ত হয় ‘স্যার’ শব্দ।

ববি চার্লটনের মৃত্যুতে ইংলিশ ফুটবলে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। এই কিংবদন্তির প্রয়াণে ১৯৬৬ বিশ্বকাপ ফাইনালে জার্মানির বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করা জিওফ হার্স্ট বলেছেন,‘আজকের সবচেয়ে দুঃখের খবর। আমরা কখনোই তাঁকে ভুলতে পারব না। একজন দারুণ সতীর্থ এবং বন্ধুকে হারালাম। তাঁকে সবাই মিস করতে যাচ্ছে নিশ্চিতভাবেই।’ চার্লটনের মৃত্যুতে ইংল্যান্ডের ’৬৬-র বিশ্বকাপজয়ী দলটির একমাত্র জিওফ হার্স্টই বেঁচে রইলেন। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও ইংল্যান্ডের সাবেক তারকা ডেভিড বেকহাম বলেছেন,‘আমি তার কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকব। তাঁর কারণেই আমি ম্যানইউতে খেলার সুযোগ পেয়েছি।’ ম্যানইউর ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি গোলদাতা ওয়েইন রুনি এখনো বিশ্বাসই করতে পারছেন না,‘আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। আমরা যখন দ্বিতীয়ার্ধের জন্য মাঠে নামতে যাব তখনি এই খবর শুনি। তিনি অসাধারণ ছিলেন। দুর্দান্ত এবং অবশ্যই ফুটবলের কিংবদন্তি।

আরেক সাবেক ফুটবলার গ্যারি নেভিল সামাজিক মাধ্যমে লিখেছে,‘একজন আইকন, একজন কিংবদন্তি এবং তাঁর প্রয়াণ বিশ্বের কাছে বড় ক্ষতি। তিনি ইংল্যান্ড ফুটবলের সেরা ফুটবলার।’ ইংল্যান্ড ফুটবল দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে আগামী মাসে ওয়েম্বলিতে একটি অনুষ্ঠান করে স্যার ববি চার্লটনকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা হবে। ওইদিন ইউরো বাছাইয়ে ইংল্যান্ড খেলবে মালটার বিপক্ষে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বর্তমান কোচ এরিক টেন হাগ বলেছেন,‘একজন কিংবদন্তি চলে গেলেন। শুধু ইংল্যান্ড নয়, বিশ্বব্যাপী সে পরিচিত।’ গতকাল রাতে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ম্যাচের আগে স্যার ববি চার্লটনের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করে রেড ডেভিলরা। ম্যানসিটি কোচ পেপ গার্দিওলা বলেছেন,‘তাঁর পরিবার, ম্যানইউ এবং ইংলিশ ফুটবল এবং ইউরোপিয়ান ফুটবলের জন্য বিশাল ক্ষতি।’
সাবেক ইংলিশ স্ট্রাইকার গ্যারি লিনেকার বলেছেন,‘আমার কাছে তিনি ইংল্যান্ডের সেরা খেলোয়াড়। আমি ভাগ্যবান যে, ছোট বেলা থেকে তাঁর খেলা দেখতে পেরেছি। তিনি সবার চেয়ে আলাদা ছিলেন। বিশ্বের যেখানেই যান না কেন, এমনকি আপনি যদি ইংলিশ ভাষা নাও জানেন তারপরেও দুইটি শব্দ জানা থাকতো-ববি চার্লটন।’

-দুরন্ত ডেস্ক