বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল দেশের ফুটবল ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় অধ্যায় রচনা করেছে। ২০২৬ এএফসি নারী এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে তারা তৈরি করেছে নতুন ইতিহাস। এটি বাংলাদেশের জন্য প্রথমবারের মতো এশিয়ান কাপের মূল পর্বে অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি হওয়া। ২০২৫ সালের ২ জুলাই মিয়ানমারের ইয়াংগুনে অনুষ্ঠিত বাছাইপর্বের ম্যাচে স্বাগতিক মিয়ানমারকে ২-১ গোলে হারিয়ে বাংলাদেশ কার্যত চূড়ান্ত পর্বে উত্তীর্ণ হওয়ার পথ সুগম করেছিল। এরপর একই গ্রুপের বাহরাইন ও তুর্কমেনিস্তানের মধ্যে ২-২ গোলে ড্র হওয়ায় বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হিসেবে চূড়ান্ত পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে দলের অসামান্য পারফরম্যান্স। বাছাইপর্বের প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশ বাহরাইনকে ৭-০ গোলে পরাজিত করেছিল। দ্বিতীয় ম্যাচে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ঋতুপর্ণার জোড়া গোলে জয়ী হয় বাংলাদেশ। দুই ম্যাচে দুই জয় নিয়ে বাংলাদেশের পয়েন্ট দাঁড়ায় ৬, যেখানে মিয়ানমার রয়েছে ৩ পয়েন্ট নিয়ে এবং বাহরাইন ও তুর্কমেনিস্তান ১ পয়েন্ট করে নিয়ে। ৫ জুলাই তুর্কমেনিস্তানের বিরুদ্ধে শেষ ম্যাচে বাংলাদেশ হারলেও হেড-টু-হেড রেকর্ডের ভিত্তিতে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হবে বাংলাদেশ। ২০২৬ সালের এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্ব অনুষ্ঠিত হবে অস্ট্রেলিয়ায়। স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়া ছাড়াও গত আসরের সেরা তিন দল জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও চীন সরাসরি চূড়ান্ত পর্বে খেলার সুযোগ পেয়েছে। বাকি আটটি স্থান পূরণ করবে বাছাইপর্বের আট গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন দলগুলো। বাংলাদেশই প্রথম দল হিসেবে বাছাইপর্ব থেকে চূড়ান্ত পর্বে উত্তীর্ণ হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে।
বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে এটি একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এর আগে ১৯৮০ সালে কুয়েতে বাংলাদেশ পুরুষ দল এশিয়ান কাপের মূল পর্বে খেলেছিল। তারপর দীর্ঘ ৪৫ বছর পর বাংলাদেশের নারী দল এই কৃতিত্ব অর্জন করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশ পুরুষ দল ২০২৭ এশিয়ান কাপের বাছাইপর্ব খেলছে, কিন্তু প্রথম দুই ম্যাচে মাত্র ১ পয়েন্ট নিয়ে তাদের চূড়ান্ত পর্বে উত্তীর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এই প্রেক্ষিতে নারী দলের সাফল্য আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। এই ঐতিহাসিক অর্জনে বাংলাদেশের নারী ফুটবলারদের অভিনন্দন জানিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি এক বার্তায় বলেন, “এটি শুধু বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের জয় নয়, বরং সমগ্র জাতির জন্য গর্বের মুহূর্ত। এটি আমাদের সম্ভাবনা, প্রতিভা ও অদম্য চেতনার জ্বলন্ত প্রমাণ”। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে এই সাফল্য ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের মর্যাদা বৃদ্ধি করবে। বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের এই সাফল্য কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। গত কয়েক বছর ধরে তারা ধারাবাহিকভাবে উন্নতি করছে। ২০২২ সালে তারা প্রথমবারের মতো সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপ জয়লাভ করে। ২০২৪ সালে তারা এই শিরোপা সফলভাবে রক্ষা করে। এছাড়া ২০২১ সালে হংকংকে ৫-০ এবং মালয়েশিয়াকে ৬-০ গোলে হারিয়ে তারা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজেদের শক্তি প্রদর্শন করেছিল। বর্তমানে দলের প্রধান কোচ পিটার জেমস বাটলারের নেতৃত্বে বাংলাদেশ নারী দল নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে।
এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্বে উত্তীর্ণ হওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ নারী ফুটবলাররা শুধু ইতিহাসই তৈরি করেনি, তারা ভবিষ্যতের জন্য নতুন সম্ভাবনার দুয়ারও খুলে দিয়েছে। টুর্নামেন্টের সেরা আট দলে স্থান পেলে সরাসরি অলিম্পিক গেমসে খেলার সুযোগ মিলবে। সেরা ছয় দল সরাসরি ফিফা নারী বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করবে। সপ্তম বা অষ্টম স্থান অধিকার করলে আন্তঃমহাদেশীয় প্লে-অফে বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পাওয়া যাবে। এই লক্ষ্যগুলো এখন বাংলাদেশের নারী ফুটবলারদের জন্য স্বপ্নের চেয়ে বেশি বাস্তব সম্ভাবনা। দলের অধিনায়ক আফঈদা খান্দাকার, শীর্ষ গোলদাতা সাবিনা খাতুন এবং ঋতুপর্ণার মতো তারকা খেলোয়াড়দের নেতৃত্বে বাংলাদেশ নারী দল এখন আন্তর্জাতিক ফুটবল অঙ্গনে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করছে। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন এবং সরকারের সমর্থনে নারী ফুটবলের অবকাঠামো ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা ক্রমাগত উন্নত হচ্ছে। ২০০৭ সালে ভিশন এশিয়া প্রোগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশে নারী ফুটবলের সূচনা হয়েছিল। এরপর ২০১১ সালে শুরু হয় বঙ্গমতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব গোল্ড কাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট। এই টুর্নামেন্টগুলো নারী ফুটবলারদের জন্য মঞ্চ তৈরি করেছে এবং জাতীয় দলের জন্য প্রতিভা সরবরাহ করেছে। বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের এই সাফল্য শুধু ক্রীড়াঙ্গনের জন্য নয়, সমগ্র জাতির জন্য গর্বের। এটি প্রমাণ করে যে সঠিক পরিকল্পনা, অধ্যবসায় এবং সুযোগ প্রদান করলে বাংলাদেশের নারীরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম। এই অর্জন বাংলাদেশের সমাজে নারীদের ক্ষমতায়ন এবং লিঙ্গ সমতার পথেও একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের এই যাত্রা শুধু শুরু মাত্র। আগামী দিনে তারা আরও বড় বড় সাফল্য অর্জন করবে – এই প্রত্যাশা সকল বাংলাদেশির। এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্বে প্রথমবারের মতো জায়গা করে নেওয়ায় অভিনন্দন জানিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বুধবার নারী ফুটবল দলের উদ্দেশে এক অভিনন্দন বার্তায় তিনি বলেন, এই অর্জন শুধু নারী ফুটবলের নয়, বরং গোটা জাতির জন্য গর্বের। এটি আমাদের সম্ভাবনা, প্রতিভা ও অদম্য চেতনার একটি অনন্য উদাহরণ। তিনি আশা প্রকাশ করেন, এই সাফল্য ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলাদেশের মর্যাদা আরও বাড়াবে।
– ইমরুল কায়েস





