প্রিয়মুখ

সাফাত ভাই; সাইক্লিংয়ের পাশাপাশি নানামুখী সামাজিক ও মানবিক কর্মকান্ড

দুরন্তের সাথে আড্ডায় সবাইকে স্বাগত। আজকের আড্ডা পর্বে আমাদের সাথে রয়েছেন নারায়ণগঞ্জ সাইক্লিস্টস কমিউনিটির এডমিন সাফাত ভাই। তার সাথে আমাদের আজকে কথা হবে দেশের অন্যতম এক্টিভ এই সাইক্লিং কমিউনিটির যাত্রা, লক্ষ্য, উদ্দেশ্যসহ সাইক্লিংয়ের পাশাপাশি তাদের নানামুখী সামাজিক ও মানবিক কর্মকান্ড নিয়ে। তো চলুন আমরা শুরু করি ।

দুরন্ত: আজকে আপনাকে দুরন্তের সাথে পেয়ে আমরা আনন্দিত। কেমন আছেন ভাই?

সাফাত: আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। আশা করি আপনিও ভালো আছেন। ধন্যবাদ এমন সুন্দর আলোচনার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য।

দুরন্ত: আমিও ভালো আছি। সাইক্লিংয়ের প্রতি এতো আগ্রহ হলো কিভাবে? নারায়ণগঞ্জ সাইক্লিস্টস কমিউনিটির যাত্রার শুরুর গল্পটা শুনতে চাই।

সাফাত: সাইক্লিংয়ের প্রতি আগ্রহ বা ভালোবাসা সেই ছোট থেকেই। ছোটবেলা স্কুলের যাওয়ার জন্য সাইকেল চালানো শুরু করি। পাশাপাশি কোচিংয়ে যাওয়া সহ বিভিন্ন যায়গার ঘুরতে যাওয়ার জন্য সাইক্লিং করতাম। আমাদের এনসিসির শুরুটা ছিল হঠাৎ করে। একদিন ফেইসবুকে ওয়াসিফ নামের একজনের ফেইসবুক পোস্ট দেখি। তিনি পোস্টে বলেন, আমরা যারা নারায়ণগঞ্জ এ সাইক্লিং করি, তারা চাইলে এক সাথে সাইক্লিং করতে পারি। সেই পোস্টের মাধ্যমে আমরা ৪/৫ জন একসাথে হলাম ও নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে এক শুক্রবার দল বেঁধে সাইকেল নিয়ে বের হয়ে যাই। পরে সেখান থেকে ভাবলাম আমরা যেহেতু সাইক্লিং করি, তাই একটা গ্রুপ বা কমিউনিটির মাধ্যমে সাইক্লিংকে ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে সাইক্লিংকে জোরদার করতে পারি। সেদিনের সেই ৪/৫জনের গ্রুপ থেকে আজ আমরা ৮০০০ এর পরিবার। আমাদের যাত্রা শুরু সেই ২০১৯ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর।

দুরন্ত: বাহ! বড় কিছুর শুরুটা হুট করেই হয় আমরা দেখি। আমরা বিগত সময়ে দেখে আসছি নারায়ণগঞ্জ সাইক্লিস্টস কমিউনিটি সাইক্লিং এর পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক ও মানবিক কাজ করে আসছে। এটা নিয়ে আপনাদের অভিব্যক্তি কী?

সাফাত: আমরা সবসময় বিশ্বাস করি, প্রতিটা মানুষের দৈনন্দিন কাজকর্মের পাশাপাশি সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ জরুরী। সমাজের পাশে দাঁড়ানো, সংকটে মানুষের পাশে থাকা, গাছ লাগানো, রক্তদান— এসব মানুষের ভালোবাসা পাওয়ার মাধ্যম। আমরা গর্বিত যে সাইক্লিংকে কেন্দ্র করে একটা মানবিক কমিউনিটি গড়ে তুলতে পেরেছি।

দুরন্ত: আপনাদের এই মানবিক কার্যক্রম নিয়ে সবাই ভূয়সী প্রসংশা করেন। সাইক্লিং নিয়ে আপনাদের ভিশন কি?

সাফাত: আমাদের লক্ষ্য, নারায়ণগঞ্জে এবং সারাদেশে সুস্থ ও সচেতন সাইক্লিং সংস্কৃতি গড়ে তোলা। যেখানে মানুষ সাইক্লিংকে শুধু শখ নয়, স্বাস্থ্য সচেতনতা, বন্ধুত্ব এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার মাধ্যম হিসেবে দেখবে। এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও যেনো সাইক্লিং ফ্রেন্ডলি পরিবেশ তৈরি হয়। ইকো-সিস্টেমে যতটুক সম্ভব কার্বন নির্গমন কমানো যায়।

দুরন্ত: অভিনব ও সুদূর প্রসারী চিন্তা ভাবনা। এই কারণেই হয়তো আপনাদের সাইক্লিং পাড়ায় প্রচলিত কথা, “সাইক্লিস্টস আর কুল পিপল”। এখান থেকে বুঝতে পারলাম কেনো আপনাদের কুল বলা হয়। আচ্ছা সাইক্লিং করা কেনো জরুরি? বর্তমান সময়ে সাইক্লিং করতে গিয়ে আপনাদের কী কী প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতো হয়?

সাফাত: সাইক্লিং মানে শুধু শরীরচর্চা নয়, এটা মানসিক চাপ কমায়, পরিবেশ দূষণ কমায়। যানজট সমস্যার একটি চমৎকার সমাধান হতে পারে সাইক্লিং। প্রতিবন্ধকতা বলতে আসলে আমাদের দেশের এখনো সেভাবে সাইক্লিং কাঠামো গড়ে ওঠেনি। নানামুখী সমস্যার মধ্যে যেগুলো না বললেই নয়, রাস্তায় নিরাপত্তার অভাব, সাইকেল লেন না থাকা, গাড়িচালকদের অসচেতনতা, সাইকেল পার্কিং ব্যবস্থা না থাকা, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি (অনেকে এখনও এটা শিশুদের খেলা বলে মনে করেন) সহ আরো অনেক সমস্যাই বিদ্যমান।

দুরন্ত: আপনারা সাইক্লিং কমিউনিটিগুলো সাইক্লিং এর পাশাপাশি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা থেকে নানা ধরনের মানবিক ও জনসচেতনমূলক কর্মকান্ড করে যাচ্ছেন। অথচ পরিবেশ বান্ধব সাইক্লিংটাই অবহেলিত। বিষয়টি আসলেই দুঃখজনক। আচ্ছা সবাইকে সাইক্লিং এ উদ্বুদ্ধ করতে সাইক্লিং কমিউনিটিগুলো কি কি ভূমিকা পালন করতে পারে?

সাফাত: বাংলাদেশে সাইক্লিংকে আরো জনপ্রিয় করতে সাইক্লিং কমিউনিটিগুলোর দায়বদ্ধতাই সবচেয়ে বেশি। কারণ তারা সাইকেল চালানো এবং এর বাস্তবতা সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি অবগত। তাই সাইক্লিং কমিউটিনিগুলো যা করতে পারে তা হচ্ছে:- নিয়মিত রাইড আয়োজন, সাইক্লিং রিলেটেড রেস ও চ্যালেঞ্জের আয়োজন করা, সাইকেলিং সম্পর্কিত সচেতনতা প্রোগ্রাম, স্কুল-কলেজে সাইক্লিং করার জন্য শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করা, নতুনদের জন্য বেসিক ট্রেনিং, ফান রাইড, কমিউনিটি আউটিং এর মতো কার্যক্রম পরিচালিত করা। সবচেয়ে বড় কথা, একটা ইতিবাচক এবং বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

দুরন্ত: বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট দেখতে পেলাম আমরা। তবে ইদানীং সাইক্লিং কমিউনিটিগুলোতে বেশ অপ্রাসঙ্গিকতা ও সাইক্লিংটাকে যথাযথ ভাবে ধারণ করতে দেখছি না। এগুলোর প্রধান কারণ এবং এর থেকে বের হয়ে সুস্থ স্বাভাবিক সাইক্লিং এ কমিউনিটিগুলো কি কি ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন?

সাফাত: এটা সত্যি, এখন অনেকেই সাইক্লিং কমিউনিটিকে সোশ্যাল স্ট্যাটাসের জায়গা বানিয়ে ফেলেছে। এতে মূল উদ্দেশ্য হারিয়ে যাচ্ছে। এর অন্যতম কারণ হিসবে আমি মনে করি,সচেতন নেতৃত্বের অভাব, কমিউনিটি নীতিমালা না থাকা, অপ্রয়োজনীয় গ্রুপের প্রতিযোগিতা, এক গ্রুপের প্রতি অপর গ্রুপের বন্ধুত্বমূলক আচরণের অভাব। এ থেকে বের হতে হলে আমাদের করনীয়গুলো হচ্ছে- নিয়মিত সচেতনতামূলক আয়োজন, নতুনদের সহযোগিতা, সর্বোপরি সিনিয়রদের আদর্শ ভূমিকা পালন প্রয়োজন।

দুরন্ত: আপনার বক্তব্যের সাথে একমত পোষন করছি। সাইক্লিং কমিউনিটিগুলোর বাইরে রাষ্ট্রীয় ভাবে সাইক্লিং বন্ধব পরিবেশ তৈরি করতে কী কী প্রয়োজন এবং রাষ্ট্রের কী কী পদক্ষেপ নেয়া উচিত বলে মনে করেন?

সাফাত: দেখুন আগেই বলেছি সাইকেল পরিবেশ বান্ধব বাহন। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য সবচেয়ে বড় ভূমিকাটা রাষ্ট্রের উপরই বর্তায়। তাই রাষ্ট্রীয় ভাবে যা যা করা যেতে পারে:- সাইকেল লেন তৈরি, রাস্তা নির্মাণে সাইকেল ব্যবস্থার অগ্রাধিকার, সাইকেল পার্কিং স্পট ও নিরাপত্তা নিশ্চিত, সরকারি বেসরকারি অফিসে ‘সাইকেল টু ওয়ার্ক’ প্রোগ্রাম ও স্কুল কলেজে সাইকেল ব্যবহারে শিক্ষার্থীদের উৎসাহ প্রদান, সাইকেল বডি ও পার্টস দেশে উৎপাদনের মাধ্যমে দাম কমিয়ে আনা, ভ্যাট-ট্যাক্স মওকুফ বা কমিয়ে আনা। রাষ্ট্র চাইলে পরিবেশবান্ধব এই মাধ্যমের প্রসার ঘটাতে পারে।

দুরন্ত: সুন্দর প্রস্তাব। এসব বাস্তবায়িত হলে আমাদের দেশে সাইক্লিং আরো সহজ ও নিরাপদ হবে। তবে নিরাপদ সাইক্লিং করার জন্য সাইক্লিস্টসদের কী কী বিষয় মাথায় রাখা উচিত?

সাফাত: রাষ্ট্র আমাদের সাইক্লিং কাঠামো গড়ে দিতে পারে। তবে নিরাপদ সাইক্লিং ও সচেতনতার দায়িত্ব সাক্লিস্টসদের নিজের। তাদের কমিউনিটি ও ব্যক্তিগত সচেতনতা সবচেয়ে বেশি জরুরি। তাই নিরাপদ সাইক্লিং এর জন্য বাধ্যতামূলক হিসেবে হেলমেট ও সেফটি গিয়ার ব্যবহার করা, রাতে অবশ্যই ফ্রন্ট ও টেল লাইট, রিফ্লেক্টর ব্যবহার করা, ট্রাফিক আইন মেনে চলা, লেন ও টার্ণ নেওয়ার সময় নিয়ম মেনে চলা, হেডফোন ব্যবহার না করা, রাস্তার একপাশে সাইকেল চালানো ও বাউলি(হঠাৎ করে লেন পরিবর্তন না করা) কখনো গাড়ির সামনে যাওয়ার চেষ্টা না করা বা অসুস্থ প্রতিযোগীতা থেকে বের হয়ে আসা।

দুরন্ত: যথার্থই বলেছেন, সুযোগ সুবিধা যতই দেয়া হোক, যদি সাইক্লিস্টসগণ সচেতনভাবে সেই সুযোগের ব্যবহার করতে না পারেন তবে দূর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব নয়। দেখতে দেখতে সাইক্লিং নিয়ে অনেক প্রশ্নই করলাম। শেষ একটা প্রশ্ন না জানলেই নয়, বর্তমান প্রজন্মকে সাইক্লিংএ উৎসাহী করা জন্য কী কী করা যেতে পারে এবং নতুনদের যারা সাইক্লিং এ যুক্ত হতে চান তাদের জন্য আপনার পক্ষ থেকে কিছু পরামর্শ।

সাফাত: এখানে খুব বেশি বড় করবো না। নতুনদের প্রতি আমার পরামর্শ থাকবে সাইক্লিং শুধু শরীরচর্চা নয়, মানসিক শান্তির জায়গা। ধৈর্য নিয়ে শিখুন। সিনিয়রদের অভিজ্ঞতা নিন। সেফটি গিয়ার ছাড়া রাইড করবেন না। এবং কমিউনিটির নিয়ম মেনে চলুন।

দুরন্ত: আপনার সাথে এই আড্ডায় অংশ নিয়ে বেশ ভালো লাগলো। আপনাদের সাইকেল উন্মাদোনার পাশাপাশি মানবিক ও জনসচেতনতা মূলক কর্মকান্ড অব্যাহত থাকুক। দুইচাকায় যাত্রা শুভ হোক। আন্তরিক ধন্যবাদ।

সাফাত: আপনাদেরও ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই সাইকেলের কথা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য।

 

– দুরন্ত আড্ডা