‘জ্ঞানই আলো, সত্যই লক্ষ্য’ এ নীতি ধারণ করে শীতলক্ষ্যা বিধৌত অঞ্চলে জ্ঞানের বাতিঘর সরকারি তোলারাম কলেজ বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ। প্রাচ্যের ড্যান্ডি খ্যাত নারায়ণগঞ্জের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। পাট এবং পৃথিবী বিখ্যাত মসলিন কাপড়ের বদৌলতে বিদেশিদের আনাগোনায় নারায়ণগঞ্জ ছিল দিনরাত কর্মচঞ্চল। সম্পদের সমৃদ্ধিতে উজ্জ্বল নারায়ণগঞ্জকে জ্ঞানের আলোকে সমুজ্জ্বল করতে ব্রতী হন দর্শনে উচ্চশিক্ষিত অসাম্প্রদায়িক বাবু খগেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। তিনি দানবীর রণদাপ্রসাদ সাহার (আরপি সাহা) শরণাপন্ন হন। উদ্যমী পুরুষের বিদ্যা-সম্পর্কিত মহাপরিকল্পনার কথা শুনে দাতা রণদাপ্রসাদ সাহা তাঁকে পঁচিশ হাজার টাকা প্রদান করেন। এরপর নারায়ণগঞ্জের পাট ব্যবসায়ী তোলারাম বসরাজের ছেলে মদন লাল সারোগীও কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য পঁচিশ হাজার টাকা প্রদান করেন। পরবর্তীতে পাশে দাড়ান মহান হৃদয়ের অধিকারী ও শিক্ষা অনুরাগী পাট ব্যবসায়ী জনাব তোলারাম বসরাজ, তিনি কলেজ নির্মাণ করার জন্য নগদ এক লক্ষ টাকা প্রদান করেন। দাতার নামানুসারে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে নারায়ণগঞ্জ হাইস্কুলের পরিত্যক্ত ব্যায়ামাগারে শুরু হয় তোলারাম কলেজ।
১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে আল্লামা ইকবাল রোডে সরকার কর্তৃক অধিগ্রহণকৃত ১.৩৩ একর জমির উপর কলেজের স্থায়ী কার্যক্রম শুরু হয়। এখানে প্রথম নির্মিত ভবনটি উদ্বোধন করেন পূর্ববঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার। কলেজটির প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল ছিলেন জ্ঞানপিপাসু, স্বপ্নদ্রষ্টা বাবু খগেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। তোলারাম কলেজ আজ সমৃদ্ধ বিদ্যাপীঠ। বর্তমান কলেজের বহুতল মূল ভবনটি তৈরি হয় ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে। দানবীর আরপি সাহার দেড় লক্ষ টাকা অনুদানে তৈরি হয় তোলারাম কলেজের বিজ্ঞান গবেষণাগার এবং ক্রয় করা হয় প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। এই কলেজের ছাত্র মোঃ সাজ্জাদ হোসেন ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে বিকম পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়ে কলেজটির সম্মান বৃদ্ধি করেন। একই বছর তোলারাম কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্থান অধিকার করে। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও এই কলেজের রয়েছে গৌরবময় ঐতিহ্য। সেই ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে কলেজের শিক্ষার্থীরা ডায়মন্ড সিনেমা হলে মঞ্চস্থ করেছিল ‘শাহজাহান’ এবং ‘মহুয়া’ নাটক।
তোলারাম কলেজের শিক্ষার্থীরা ঐতিহ্যগত কারণেই রাজনীতি সচেতন। এ কলেজের শিক্ষার্থীরা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ঐতিহাসিক ৬ দফা, ১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থান ও ১৯৭১ সালের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। মহান মুক্তিযুদ্ধে শহিদ হন তোলারাম কলেজের স্নাতক শ্রেণির ছাত্র আব্দুল আওয়াল।
১৯৮০ সালের ১ মার্চ কলেজটি জাতীয়করণ করা হলে সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কলেজের কার্যক্রমে গতিশীলতা বৃদ্ধি পায়। ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দেন তোলারাম কলেজের শিক্ষার্থীরা। এতে কলেজের অনেক শিক্ষার্থী আহত ও নিহত হয়। বর্তমানে কলেজটিতে উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক(পাস), ১৪টি বিষয়ে স্নাতক (সম্মান), ৯টি বিষয়ে স্নাতকোত্তর প্রথম পর্ব এবং ১৪টি বিষয়ে স্নাতকোত্তর শেষপর্ব প্রোগ্রাম চালু রয়েছে। বর্তমানে সরকারি তোলারাম কলেজে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের সংখ্যা প্রায় ২৭ হাজার। সরকারি তোলারাম কলেজের সহশিক্ষা কার্যক্রমও উন্নত।
সহশিক্ষা কার্যক্রমে রয়েছে রোভার স্কাউট (৫টি ইউনিট), বিএনসিসি, রেঞ্জার, রেডক্রিসেন্ট, সঙ্গীত শিক্ষা, বিজ্ঞান ক্লাব ও বিতর্ক ক্লাব। নিয়মিতভাবে এই কলেজে ইনডোর গেইম, আউটডোর গেইম, বার্ষিক মিলাদ, বার্ষিক বনভোজন এবং শিক্ষা সফর অনুষ্ঠিত হয়। এই কলেজে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীর মধ্যে রয়েছে মধুর সম্পর্ক। এর ফলে কলেজের ফলাফল অত্যন্ত সন্তোষজনক। ভাল ফলাফলের কারণে ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে সরকারি তোলারাম কলেজ জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ কলেজ রূপে পুরস্কৃত হয়। সরকারি তোলারাম কলেজ থেকে শিক্ষা লাভ করে অনেকে জাতীয় পর্যায়ে সফল ও স্বনামধন্য হয়েছেন। এই কলেজের সুনাম এভাবেই ছড়িয়ে পড়েছে দিগ্বিদিক।
– মোহাম্মদ জাহিদ





