প্রিয়মুখ

আড্ডায় শাম্মী তুলতুল

বর্তমানে বাংলাদেশের জনপ্রিয় লেখকদের মধ্যে একজন শাম্মী তুলতুল। তিনি একাধারে লেখক, ঔপন্যাসিক, শিশুসাহিত্যিক,আবৃত্তিশিল্পী,ব্র্যান্ড এম্বাসেডর পাঠাগার আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ বেতার চট্টগ্রাম কেন্দ্রের অনুষ্ঠান পরিচালক ,ও ঢাকার মেয়র হানিফ স্মৃতি সংসদের সাহিত্য সম্পাদিকা এবং দাবা খেলোয়াড় হিসেবেও পরিচিত।সংযুক্ত আছে বাংলাদেশ শিশু সাহিত্য ফোরামের সাথেও। বর্তমানে বেস্ট সেলার তালিকায় তার নাম অন্তর্ভুক্ত। শাম্মী তুলতুলের সাথে আড্ডায় আছেন দুরন্ত প্রতিনিধি ফৌজিয়া আহমেদ পল্লী।

– কেমন আছেন আপু?
শাম্মী তুলতুলঃ আলহামদুলিল্লাহ এখনো ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?
– এই তো ভালো। আচ্ছা আপু আপনার সাহিত্যের জগতে প্রবেশের গল্প শুনতে ইচ্ছে করছে।
শাম্মী তুলতুলঃ আমার পরিবারটা ছিল সাহিত্য ও সংস্কৃতিমনা। বিশাল সাহিত্যের ভাণ্ডার। আমার বাবা আবু আলহাজ আবু মোহাম্মদ ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা আর দাদা ছিলেন লেখক, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেতা, কবি কাজী নজরুলের বাল্যকালের বন্ধু। তাছাড়া মা রওশন আখতারের দাদা ছিলেন কবি দৌলত কবি।
এছাড়াও আমার নানু কাজী লতিফা হক ছিলেন বিখ্যাত “বেগম” পত্রিকার সুপরিচিত লেখকও গীতিকার। আম্মুর চাচীর বোন নুরজাহান মোরশেদ নারী নেত্রী আর লেখালেখির সাথে যুক্ত ছিলেন। আমার পুরো পরিবারটাই ছিল শিক্ষা দীক্ষা আর সাহিত্যের সাথে যুক্ত। ছোট বেলায় মায়ের কাছে গল্প শুনতাম। বাবা আর দাদুর কাছে শুনতাম মুক্তিযুদ্ধের গল্প। কবি নজরুল আমাদের গ্রাম এসেছিলেন ১৯৩২ সালে। সে সুবাধে আমার দাদুর সাথে তার গভীর বন্ধুত্ব হয়। আমার গ্রাম রাউজানের বিখ্যাত নদী হালদা নদী ঘেঁষা। যে নদী পার হয়ে নজরুল আমাদের গ্রামে আসেন। কিন্তু আমার জন্ম বেড়ে ওঠা চট্টগ্রাম শহরেই। দাদুর কাছেই শুনতাম কবির মজার মজার গল্প। একটা চমৎকার আর অভিজাত পরিবার ছিল আমার।
সেই থেকেই মাথায় আসতো ছড়া, কবিতা, গল্প লেখার শুরুটা। দাদুর নাম দেখতাম পত্রিকায় ছাপার অক্ষরে। দেখেই ভাবতাম ইসস আমারও যদি নাম আসতো এভাবেই ব্যাস শুরু হয়ে গেলো বাবার হাত ধরে পত্রিকা অফিসে যাওয়া। আমি যখন ক্লাস থ্রি-তে পড়ি তখন ক্লাব ম্যাগাজিনে আমার প্রথম ছড়া ছাপা হয়। একে একে ২০০৬ থেকে আমি নিয়মিত লিখছি দৈনিক প্রথম আলো,কালেরকণ্ঠ, বাংলাদেশ প্রতিদিন, যুগান্তর, সমকাল, শিশু, নবারুণ, ভোরের কাগজ দৈনিক আজাদী পূর্বকোণ এবং ভারতের বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় ও দেশের বাইরের অস্ট্রেলিয়া ,সিংগাপুর জার্মানির বিভিন্ন প্রকাশিত পত্রিকায়।
আমি পড়ালেখায় অনেক ফাঁকিবাজ ছিলাম। গান নাচ আবৃত্তি লেখালিখিতে মনোযোগ ছিল বেশি। তবে লেখালেখিটাকে আয়ত্ত করেছি বেশী। কিন্তু আমার মা দুই জায়গায় ব্যাল্যান্স করে আমাকে নজর দিতো। একদিকে আমার পড়ালেখা অন্যদিকে আমার প্রতিভার ব্যাঘাত ঘটাতে দেননি কখনোই। মা উচ্চশিক্ষিত ছিলেন তাই তিনি আমার প্রতিভারও গুরুত্ব দিয়েছেন বেশী।আমি হয়েছিও আজ দেশ সেরা কলেজ চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্রী। এখন পড়ছি আইন বিভাগে। তবে নিজে প্রতিভার অগস্রর হওয়ার ক্ষেত্রে নিজের ইচ্ছে, আগ্রহ থাকা অবশ্যই জরুরী। ইচ্ছে না থাকলে কোন কিছুইতেই সফলতা আসে না।
– আপনার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা এই পর্যন্ত কয়টি?
শাম্মী তুলতুলঃ ১৩ টি। এর মধ্যে উপন্যাস চারটি আর ছোটোদের বই বেশি রয়েছে। আমি শিশুদের বেলায় খুব চেষ্টা করি সহজ সরল ভাষায় লিখতে।
– আচ্ছা আপু আপনার প্রথম উপন্যাস কবে প্রকাশিত হয়?
শাম্মী তুলতুলঃ প্রথম উপন্যাস বের হয় ২০১৬ সালে। এটি মুক্তিযুদ্ধের পটভূমির ওপর লিখিত ছিল । শীর্ষ প্রকাশনী অনিন্দ্য প্রকাশ থেকে প্রকাশিত।
– আপনার প্রথম উপন্যাস শেষ করতে কতদিন সময় লেগেছিল?
শাম্মী তুলতুলঃ তিন বছর। এটা হচ্ছে তোমার গুনের ওপর নির্ভর করে। এলোমেলো মানের বই চাইলে এক বছরে লেখা যায়। তবে যদি উদ্দেশ্য হয় বইটি মানুষ বার বার পড়বে তবে অনেক তথ্য সংগ্রহ করে গুছিয়ে লিখতে হবে।
– মুক্তিযুদ্ধের পটভুমি নিয়ে লিখতে উৎসাহ কি আপনার বাবার কাছে পেয়েছেন?
শাম্মী তুলতুলঃ জী আব্বুর কাছ থেকেই পেয়েছি ।
– আপু আপনার কোনো বইয়ে নিজের প্রতিচ্ছবি রয়েছে কী?
শাম্মী তুলতুলঃ যেকোনো গল্প পড়লে বুঝবে আমাদের চারপাশের সাথে মিলে যায় বা আমাদের জীবনের সাথে কল্পনা আর বাস্তব মিলিয়েই কিন্তু আমরা গল্প লিখি।
– নিজের বানানো কোন চরিত্রের সাথে নিজের মিল খুঁজে পান? কোন বইয়ের কোন চরিত্র?
শাম্মী তুলতুলঃ আমার মন জুয়াড়ি উপন্যাসে মায়ের একটা চরিত্র আছে,এটা আমার মায়ের সাথে মিলে।
– আচ্ছা আপু আর অন্যদের গল্পের ক্ষেত্রে নিজের সাথে মিল পাওয়া যায় এমন চরিত্র পেয়েছেন?
শাম্মী তুলতুলঃ হ্যাঁ, কিছু কিছু দিকে মিল পাওয়া যায়। যেমন নারীর স্বাধীনতা কম থাকে। এই যুগ কিংবা আগের যুগ সব ক্ষেত্রেই। আমি রক্ষণশীল পরিবারে বড় হয়েছি। মা খুব কড়া ছিলেন। তবে প্রতিভা বিকাশের স্বাধীনতা ছিলো।
– আপনার প্রিয় সাহিত্যিক কে?আর প্রিয় উপন্যাস কোনটি?
শাম্মী তুলতুলঃ প্রিয় লেখক অনেকেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মানিক বন্দোপাধ্যায়, জহির রায়হান, জাকির তালুকদার। আর প্রিয় উপন্যাস ‘পথের পাঁচালি’।
– কোন ধরণের উপন্যাস ভালো লাগে?
শাম্মী তুলতুলঃ সব ধরনেরই ভালো লাগে।সব ধরন না পড়লে কে লিখলো জীবন নিয়ে তা বোঝা যায় না।
– কবিতা লিখছেন কি? কবিতা প্রকাশ এর ইচ্ছে আছে?
শাম্মী তুলতুলঃ কবিতা কম লিখি।এটা আমার কাছে কঠিন মনে হয় তবে কবিতা সাহিত্য এর বড় দিক।তাই অনেক ভেবে চিনতে লিখতে হয় । কবিতার বই বের করার ইচ্ছে আপাতত এখন নেই।
– যারা লেখক হতে চায় তাদের করনীয় কি?
শাম্মী তুলতুলঃ প্রথমে কিছু বই পড়তে হবে যেমন নজরুল, রবীন্দ্রনাথ এর ছোট গল্পের বই পড়বে নজরুলের ছোট গল্পের বই এর পর চেষ্টা করবে প্রথমে ৫০০ শব্দের একটি মনের মতো ঘটে যাওয়া কিছু কাল্পনিক ভাবে ঘটনা লিখতে। এভাবেই শুরু হবে। তবে ধৈর্য ধারণ করতে হবে প্রচুর।
– শুনেছি নতুন বই বের করবেন হালদা নিয়ে। এর কনসেপ্ট কি?
শাম্মী তুলতুলঃ এটা নদীর আশপাশ জেলেদের জীবন চিত্র যে টা হালদা সিনেমায় উঠে আসে নাই তার অনেকটা উপন্যাসে আনার চেষ্টা করবো। কিছু সত্য কাহিনীও।
– লেখক পরিচয় ছাড়া ও আপনার আরো একটি পরিচয় আছে…
শাম্মী তুলতলঃ লেখালেখি ছাড়া আমি বেতারে অনুষ্ঠান গ্রন্থনা করি আর আবৃত্তি করি।
– আচ্ছা আপনার শহরে পাহাড়, সমুদ্র, নদী সব আছে। কোনটা বেশি প্রিয়?
শাম্মী তুলতুলঃ কোন টা কোনটার চেয়ে কম নয় আমার আমার কাছে । দুটোই প্রিয় এসব দেখেই বড় হয়েছি তাই দুটার কাছে গেলেই মন ভালো হয়ে যায়।
– লেখার সময়ে কোন ধরনের পরিবেশ ভালো লাগে। বা কি পরিবেশে লিখতে পছন্দ করেন?
শাম্মী তুলতুলঃ নিরিবিলি একদম আমার বেলায় রাতেও লিখি দিনেও সময় দিই ঘরের কাজ না থাকলে। কিন্তু পরিবেশটা নীরব হতে হতে হয়।
– ভারতে কোন কোন বই প্রকাশ পেয়েছে?
শাম্মী তুলতুলঃ না এখনো প্রকাশ পায়নি তবে আগামীতে হবে কথা বলেছি। তবে তাদের পত্রিকায় নিয়মিত লিখছি।
– আচ্ছা আপু সিনেমা দেখতে কেমন লাগে? সিনেমা নিয়ে আপনার দর্শন কি?কেমন সিনেমা ভালো লাগে?
শাম্মী তুলতুলঃ এটা দরকারি প্রশ্ন। সিনেমার বিষয়টি বিশদ ।তবুও সংক্ষেপে বলি এখন যেসব সিনেমা বাণিজ্যিক বানানো হচ্ছে এগুলো তেমন ভালো লাগে না। আমি কয়েকমাসে ধরে ৯০ এর দশক ৭০ এর দশক এর ফিল্ম দেখে খুব অবাক। এতো সুন্দর ডায়লগ, অভিনয় , কাহিনী প্রেম ভালোবাসা রোমান্স এসব আসলে এখনের ফিল্ম এর সাথে আকাশ পাতাল। তবে যারা নাটক বানায় তাদের অনেকেই মোটামুটি ভালো সিনেমা তৈরি করছেন।কিন্তু বাংলা চলচ্চিত্র এর উন্নতি না হলে এই প্রজন্ম কোন সিনেমায় মনে রাখবে না। যেমন আমি কোন সিনেমা দেখিনি তাই বলতেও পারবোনা।
– গান নিয়ে আপনার দর্শন কি?
শাম্মী তুলতুলঃ আমার কাছে মনে হয় এটি প্রতিভার বিষয়। এতে গলা ও মনে কাজ দুই-ই লাগে। আমি ছোট বেলায় শিখেছি কিন্তু এখন নিয়মিত নই।
– গান শোনার বেলায় কোন ধরনের পছন্দ?
শাম্মী তুলতুলঃ রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনি আর আমার নানী গীতিকার, উনার সুন্দর গান আছে- ওগুলো অসম্ভব ভালো লাগে আর এই সময়ের অনেকের শোনা হয়। আমাদের দেশের শিল্পী দের গান আমার খুব ভালো লাগে।
– আচ্ছা আপু নতুন লেখকদের জন্য কোন উপদেশ?
শাম্মী তুলতুলঃ নতুনদের সম্পর্কে যেটা হয় ধৈর্যটা কম। অনেককে দেখি আমার এই বয়সী এসে অনেকে হঠাৎ লিখা শুরু করেন এতে দেখি তারা একটা লিখা লিখে বা বই লিখে খুব দ্রুত এগোতে চায়। অথচ আমার দৌড় সেই ১৩ বছর আগে ।এই দৌড় বন্ধ করতে হবে। এক দুটো লিখে অনেকে বই বের করতে চায় এটা যেন না করে।আপনার বয়স কম হোক কিন্তু কাজের ক্ষেত্র যদি বেশী হয় তাহলে আপনাকে এগিয়ে যেতে কেউ বাধা দিতে পারবে না।
– আপু, অনেক অনেক ধন্যবাদ সময় দেওয়ার জন্য। তবে আপনার সাথে সরাসরি আড্ডা দিতে পারলে আরো আনন্দিত হতাম।
শাম্মী তুলতুলঃ হ্যাঁ, আমারও ভালো লাগতো। অনেক দিন কারো সাথে দেখা হয় না।

-দুরন্ত ডেস্ক

Leave a Reply