দাঁড়িয়ে আছি নীলক্ষেতের বইয়ের দোকানে।খুঁজছি “টেনিদা সমগ্র”।প্রতি সেকেন্ডে মনে পড়ছে আমাদের টেনিদা কে, হই হই করা আমাদের টেনিদা।রবিদা আমাদের পাড়ার সুপারম্যান।মানে আমাদের জেনারেশনের কাছে যে মানুষটা আমাদের সব বদ আবদারগুলো বাবা মার অগোচরেই মিটিয়ে দিতো সেই মানুষটার নাম “রবি দা”,তার আসল নাম “রবিদেব গাঙ্গুলী”,তাঁর কাছের মানুষ ,প্রাণের মানুষ,যাঁকে সে অনুসরণ করে চলেছেন জীবনভর ,তার নাম “টেনিদা”।”ডি-লা-গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস।ইয়াক ইয়াক।”-এ কথাটি তাঁর সাথে থাকলে দিনে ১০-১৫বার শুনতেই হতো,নিজেকে যেনো এর মধ্যে দিয়েই প্রমাণ করতে চেতো পটলডাঙার টেনিদার কার্বন কপি আজ আমাদের পাড়ায়। টেনিদার সাথে ভাব হওয়ার আরেকটি বড় কারণ হলো স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষা। যাঁদের কাছে পরীক্ষা মানেই সব জোচ্চুরি। তাঁর আর পড়াশোনাতে মন নেই,তাঁর ও যেকোনো একটা ক্লাসের পুরোনো মানুষ হবার খুব সাধ ,যেকিনা নতুনদের মেরেধরে একটু মানুষ করে নেবে,কিন্তু কাকু হেডমাস্টার হওয়ায় সেই সুযোগটা ঠিক তাঁর হয়নি কখনো ,কাকু মেরে ধরে তাঁকে প্রত্যেকবার উতরে দিয়েছে।পটলডাঙার চাটুজ্যেদের রোয়াকের মতন আমাদের পাড়ারো মতিনের চায়ের দোকান ছিল ,যেখানে বসেই প্রতিদিনকার আড্ডা জমাতো আমাদের টেনিদা ,আমাদের টেনিদার কাছেও ছিলো কেবল ঝুড়িভরা গল্প।টেনিদার মতন সেও ভুতে ভয় পেলেও তা স্বীকার করেনি কোনোকালে , আমাদের পাড়ায় ছিলো এক পুরনো আমলের বাড়ি,তাতে গাছপালা জন্মানোয় বেশ অন্ধকার থাকতো সারাক্ষণ,তো একবার ঠিক হলো আমাদের টেনিদা ওরফে রবিদা আমাদের দলকে নিয়ে থাকবে ওখানে।তো রাত তখন প্রায় ১২টা হঠাৎ চিল চিৎকার। কার চিৎকার কার চিৎকার করতে করতে আবিষ্কার হলো আমাদের বীরমশাই রবিদার চিৎকার,স্বপ্নে সে ভুতের দেখা পেয়েছে।এভাবেই রবিদা থেকে টেনিদা করতে করতে আমাদের মজার দিনগুলো কাটছিলো।কিন্তু হুট করেই শোনা গেলো রবিদার ক্যান্সার,টেনিদার মতন বুকের পাটা ছিলো কিনা তাই শেষ অবধি বলতে শুনেছিলাম “আরে তোরা নেতিয়ে পড়লি রে..যা যা খেলতে যা”।রবিদার বড় গুণ হলো তিনি বই পড়তেন ,অনেক বই পড়তেন,উনিই তো আমাকে আমার ১০তম জন্মদিনে দিয়েছিলেন “টেনিদা”।উপহারটা হাতে দিতে দিতে বললেন,”ছুটকি,এই নে,বেকার তো তাই বেশি কিছু দিতে পারলাম না ,কিন্তু তোর জন্যে বুক ভরা ভালোবাসা রেখে গেলাম রে,।টেনিদা বইটা শেষ করতে এক সপ্তাহ লেগেছিলো,টেনিদা পড়া শেষ হলো, টেনিদার মতন একজন মজার মানুষের সাথে পরিচিত ও হলাম ,বুঝতে পারলাম কেনো আমাদের রবিদাই আমাদের পাড়ার টেনিদা।কিন্তু এটা বুঝতে পারলাম না আমাদের টেনিদা আমাদের সাথে আর বেশিদিন থাকবেন না।বছর না গড়াতেই টেনিদা চলে গেলেন কোমায় ,আমরা ওনার বাচ্চার পার্টি প্রায় প্রতিদিনই যেতাম উনি চোখ মেলে কিছু বললেন কিনা সেটার আশায় । কিন্তু আমাদের টেনিদা আমাদের জীবনের খানিকটা আনন্দকে কাছে এনে দিয়ে আমাদের না বলেই চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে ।সেদিন বাসায় গিয়ে খুব কেঁদেছিলাম বইটা জড়িয়ে,তারপর কি মনে হলো বইটা ভোরের দিকে তুলে রেখেছিলাম আলমারিতে।এখন আমার ৩৪ চলছে,এত বছর ধরে “টেনিদা সমগ্র”-টি আগলে রেখেছিলাম ,কিন্তু কোনোদিন আর পৃষ্ঠা উল্টাইনি বইটার,খু্ব কষ্ট হতো ,কেমন যেনো মনে হতো দৌড়ে চলে যাই আমাদের টেনিদার কাছে,কিন্তু পরক্ষণেই মনে হতো আর কোনোদিন শুনতে পারবো না “ব্যাটা কোথাকার গাড়ল রে”,টেনিদার এই কথাগুলো আমাদের রবিদার মুখে ,তখনই মনটা মুছড়ে উঠতো অজানা এক অভিমানে।আজ আমার মেয়ের জন্যে কিনতে এসেছি ” টেনিদা সমগ্র”,টেনিদার সাথে তার সাক্ষাৎ হওয়াটা দরকার ,তার জীবনকে রঙিন করতে । আমাদের টেনিদার সাথে তার দেখা করাতে না পারলেও এবার তার সাক্ষাৎ হবে গল্পের টেনিদার সাথে।এই আনন্দটা মনে হয় আমাদের টেনিদা উপর থেকে ঠিকই উপভোগ করছেন,হাজার হোক তাঁর প্রাণের টেনিদা তো। টেনিদা আমাদের মাঝে আনন্দের জোগান দিয়ে যাবে চিরকাল ,আর রেখে যাবেন হাজারো দুষ্টু মিষ্টি স্মৃতি।
নাম: মাহফুজ আফনান অপ্সরা
ক্লাস:১২
কলেজ: বিএএফ শাহীন কলেজ ঢাকা





