চোখে দেখা, স্বাদ গ্রহণ, স্পর্শ অনুভব করার মতো ইন্দ্রিয়োলদ্ধ অনুভূতিগুলো সাধারণ মানুষ হিসেবে সবার মধ্যেই থাকে। তবে আপনি কি জানেন পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষ আছে যাদের এই ইন্দ্রিয়োলদ্ধ ব্যাপারটি একত্রে ঘটে? যাকে বাংলায় যুগ্মবেদক এবং ইংরেজিতে সিনেস্থেশিয়া বলে।
ডি.এন.এ ভেরিয়েশন কারণে উৎপত্তি এই অবস্থাটি অনেকেই অসুখ বা রোগ হিসেবে বিবেচনা করলেও এই ব্যাপারটিকে নিউরোসায়েন্স কোন রোগ বা অসুস্থতা হিসেবে বিবেচনা করে না। বরং শিল্প সত্ত্বার অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অনেকেই এই অবস্থাকে বিশেষত্ব বা বরদান হিসেবেই মেনে নিয়েছেন।
প্রতি পঁচিশ হাজার মানুষের মধ্যে একজন এই ধরণের জেনেটিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন। যা এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে চলে আসে। মূলত যাদের মধ্যে এই বিশেষত্ব রয়েছে তাদের সিনেস্থেট বলা হয়। সিনেস্থেশিয়া যাদের মধ্যে পরিলক্ষিত তারা অনেকে শব্দের বিভিন্ন রং দেখতে পান। অনেকে শব্দ বা রঙের আওয়াজ শুনতে পান। কোন সংখ্যা কতো দূরে তাও অবস্থান অনুভব করতে পারেন।
সিনেস্থেশিয়া সাধারণত চার ধরনের।
- গ্রফিম কালার সিনেস্থেশিয়া
- ক্রোমোস্থেশিয়া
- স্পেশাল সিকুয়েন্স সিনেস্থেশিয়া
- অডিটোরি ট্যাকটাইল সিনেস্থেশিয়া
গ্রফিম কালার সিনেস্থেশিয়াই বেশির ভাগ সিনেস্থটদের মধ্যে দেখা যায়। এরা বর্ণ এবং সংখ্যার রং দেখতে পান। এবং প্রতিটা বর্ণ বা সংখ্যার রং সব সময় একই থাকে।
ক্রোমোস্থেশিয়া যাদের মধ্যে পরিলক্ষিত তারা শব্দ দেখতে পান। কখনো বা শব্দের প্রাচুর্য্যে দেখতে পান রঙের বিচ্ছুরণ। এই রংগুলো একেক জনের কাছে একেক রকম হয়।
স্পেশাল সিকুয়েন্স সিনেস্থেশিয়ায় অন্তর্ভুক্ত সিনেস্থেটরা একটু ভিন্ন হয়। এরা বিভিন্ন শব্দ বা সংখ্যাকে বিভিন্ন জায়গায় অনুভব করতে পারেন। যেমন ১ সংখ্যাটি খুব দূরে আবার ২ সংখ্যাটি খুব কাছে। এই ধরণের সিনেস্থেটদের স্মৃতিশক্তি খুব প্রখর হয়ে থাকে।
অডিটোরি ট্যাকটাইল সিনেস্থেশিয়ার সিনেস্থেটরা শব্দ অনুভব করতে পারেন। বিভিন্ন শব্দ তাদের ত্বকে একেক রকম অনুভুতি সৃষ্টি করে। এই প্রকারটি খুব কমই পরিলক্ষিত হয়।
এই চার ধরণ ব্যতিত দুটি অপ্রতুল এবং চমকে দেওয়ার মত ধরণ রয়েছে। যার মধ্যে একটি হচ্ছে মিরর টাচ। মিরর টাচ সিনেস্থট মানুষ বিশেষ কোন মানুষকে দেখলে, সেই মানুষের অনুভূতি অনুভব করতে পারেন। যেমন তার সামনে কাউকে ঘুষি মারলে, তিনি একই স্থানে ব্যাথা অনুভব করেন।
অন্য ধরণটি হলো লেক্সিকাল গ্যাস্ট্যাটরি সিনেস্থেশিয়া। এই ধরণের সিনেস্থেটরা যেকোন শব্দের স্বাদ পায়। যেমন, তার কাছে পিয়ানোর শব্দ তেতো কিংবা মিষ্টি। এই ধরণের সিনেস্থেট, সমগ্র সিনেস্থেটদের মধ্যে প্রতি হাজারে মাত্র দুইজন পাওয়া যায়।
ব্রিটেনের টেইট আর্ট মিউজিয়াম সিনেস্থেশিয়াকে এক ধরণের আর্ট ফর্ম হিসেবে সংজ্ঞায়ন করেছে।
পুরুষদের তুলনায় নারীদের মধ্যে সিনেস্থেশিয়া হওয়ার সম্ভাবনা ছয় গুন বেশি থাকে। সাধারণ মানুষের তুলনায় সিনেস্থেটদের মধ্যে শিল্প, সাহিত্য কেন্দ্রিক কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্ট থাকার সম্ভাবনা আট গুন বেশি থাকে। অনেক বিশ্ববিখ্যাত শিল্পী,বিজ্ঞানী,লেখকদের মধ্যে সিনেস্থেশিয়া দেখা দিয়েছে। বিখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান ছিলেন গ্রাফিম কালার সিনেস্থেট। তার অভিজ্ঞতা তিনি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন –
” যখন আমি কোন সমীকরণ দেখি, আমি বর্ণগুলোকে একেকটি রঙে দেখি। আমি জানি না কেন। যখন আমি কথা বলি, আমি বই থেকে বেসেল ফাংশন দেখতে পাই। যার মাঝে j হালকা বাদামি, n কিছুটা নীলচে বেগুনী, আবার x গুলো গাঢ় বাদামি। না জানি ছাত্রদের কাছে সমীকরণগুলো কেমন লাগে। “
বিশ্ববিখ্যাত সুরকার হ্যানস জিমার একজন ক্রোমোসিনেস্থেশিট। তিনি বলেন –
” যখন কথা বলা শুরু করি, আমার মনে হয় এটার হিসেব রাখতে হবে আমি রং শুনতে শুরু করি। একজন আঁকিয়ে রং দেখে আর আমি রং শুনি। “
বর্তমানের জনপ্রিয় মার্কিন গায়িকা বিলি আইলিশ তার সম্পর্কে বলেন –
“আপনার মস্তিষ্কের এমন একটি জিনিস যেখানে আপনি সবকিছুর সাথে এলোমেলো জিনিস যুক্ত করেন। সুতরাং উদাহরণস্বরূপ, সপ্তাহের প্রতিটি দিনের একটি রঙ, একটি সংখ্যা, একটি আকৃতি রয়েছে। কখনও কখনও জিনিসগুলির গন্ধ থাকে যা আমি ভাবতে পারি কিংবা তাপমাত্রা বা টেক্সচার অনুভব করতে পারি।”
সিনেস্থেশিয়ার মত জিনেটিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়া একটা বরদানের চেয়ে কম কিছু নয়। কেমন হতো যদি মানুষের মনের অনুভূতিগুলোও অনুভব করা যেত? এটাও তো অসম্ভব কিছু নয়।
-লামিসা সানজানা, দুরন্ত প্রতিনিধি





