জানার আছে অনেক কিছু

চশমা: ইতিহাস, প্রয়োজন আর ভবিষ্যতের গল্প।

মানুষের দৃষ্টিশক্তি পৃথিবীকে জানার প্রধান দরজা। কিন্তু এই দরজা সবসময় পরিষ্কার থাকে না। কখনো বয়সের কারণে, কখনো জন্মগত কারণে, আবার কখনো অতিরিক্ত ব্যবহারজনিত কারণে। চোখের তাই মাঝেমধ্যেই সাহায্য দরকার হয়। সেই সাহায্যের নাম—চশমা।

চশমার গল্প শুরু বহু পুরোনো সভ্যতায়। মিসরের প্রাচীন চিত্রলিপিতে দেখা যায় মানুষ জিনিস স্পষ্টভাবে দেখার জন্য স্বচ্ছ পাথর বা কাঁচ ব্যবহার করত। রোমান সভ্যতায়ও অনুরূপ কাহিনি মেলে। সম্রাট নিরো নাকি গ্ল্যাডিয়েটরদের লড়াই উপভোগ করার সময় বিশেষ কাঁচ ব্যবহার করতেন। এগুলো আধুনিক চশমা ছিল না, তবে ধারণার বীজ বপন করেছিল।

১২৮৬ সালে ইতালির জিওর্দানো দা পিসা প্রথমবার লেন্সকে কাঠ বা চামড়ার ফ্রেমে বসিয়ে ব্যবহারযোগ্য একধরনের চশমা তৈরি করেন। সেটি মুখে পরে রাখা যেত না; বরং হাতে ধরে চোখের সামনে ব্যবহার করতে হতো। সেই সময়ে সন্ন্যাসীদের কাছে এটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

এরপর ১৭২৭ সালে আরেক ইতালীয় উদ্ভাবক গিরোলামো সাভোনারোলা আধুনিক ধাঁচের নকশা তৈরি করেন। তাই তাঁকে আধুনিক চশমার জনক বলা হয়। ধীরে ধীরে ইংল্যান্ডের বেঞ্জামিন মার্টিন এবং আমেরিকার বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন চশমায় নতুনত্ব যোগ করেন—কাছ ও দূর দুটোই দেখা যায় এমন লেন্স আবিষ্কার ছিলো তার মধ্যে সবচেয়ে চমকপ্রদ।

১৯ শতকে শিল্প বিপ্লবের কল্যাণে চশমা আর কেবল অভিজাতদের বিলাসী জিনিস রইল না। প্রচুর লেন্স ও ফ্রেম তৈরি হওয়ায় সাধারণ শ্রমজীবী মানুষও ব্যবহার শুরু করল। ধীরে ধীরে চশমা হয়ে উঠলো চিকিৎসাজনিত প্রয়োজনের পাশাপাশি ব্যক্তিত্ব প্রকাশের অংশ। এমনকি এটি ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তেও প্রতীকী হয়ে উঠেছে—যেমন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা মহাত্মা গান্ধীর গোলাকার চশমা, যা একসময় তাঁর সরল জীবন ও সংগ্রামের প্রতীক ছিল। পরবর্তীতে সেই চশমা নিলামে বিক্রি হয় প্রায় ২৫০ কোটিরও বেশি টাকায়, যা প্রমাণ করে একটি সাধারণ বস্তু কতটা ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করতে পারে।

আজ চশমা আর শুধু দৃষ্টি শক্তি ঠিক রাখার মাধ্যম নয়। প্রযুক্তি একে পরিণত করছে “স্মার্ট” বস্তুতে। গুগল এক্স এমন চশমার পরিকল্পনা করেছে যা দেয়ালের ভেতর তার কোথায় আছে জানাবে, মানচিত্রে পথ দেখাবে, ভিডিও কল ও মেসেজ পাঠাবে, এমনকি কেনাকাটাতেও সাহায্য করবে।

একসময় চশমা ছিলো সীমিত মানুষের সম্পদ, আজ তা কোটি মানুষের অপরিহার্য সঙ্গী। ইতিহাসের নানা বাঁক পেরিয়ে চশমা এখন ভবিষ্যতের প্রযুক্তির হাতিয়ার। চোখের দুনিয়াকে স্পষ্ট করে দেখানোই শুধু নয়, আগামী দিনে আমাদের জীবনযাপনকেও আরও সহজ করে তুলতে পারে এই ছোট্ট জিনিসটি।

-অংকিতা রায় চৌধুরী