ইতিহাসে চাঁদের বুকে প্রথম পা রাখেন নিল আর্মস্ট্রং, এই তথ্য আমরা সবাই জানি। কিন্তু আরও একটু গভীরে গেলে দেখা যায়, চাঁদের আশেপাশে ঘুরে পৃথিবীতে ফিরে আসা প্রথম জীবন্ত প্রাণী কিন্তু মানুষ নয়, ছিল দুটি সাধারণ রাশিয়ান স্টেপ কচ্ছপ। ১৯৬৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘Zond 5’ নামক একটি মহাকাশযান চাঁদের চারপাশ প্রদক্ষিণ করে সফলভাবে পৃথিবীতে ফিরে আসে এবং সেই যানটিতেই ছিল এই দুটি কচ্ছপসহ কয়েক ধরনের জীবিত প্রাণী ও উদ্ভিদের নমুনা। মূলত মহাকাশ অভিযানে জীবন্ত প্রাণী পাঠানোর উদ্দেশ্য ছিল একটি জটিল বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা। বিজ্ঞানীরা জানতে চেয়েছিলেন মহাকাশের শূন্য মাধ্যাকর্ষণ, অতিবেগুনি রশ্মি ও দীর্ঘমেয়াদি ওজনহীন পরিবেশ জীবন্ত শরীরের উপর কেমন প্রভাব ফেলে। সে জন্য মানুষ পাঠানোর আগে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নেওয়া ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই মিশনের অংশ হিসেবেই ২ সেপ্টেম্বর কচ্ছপদুটিকে মহাকাশযানে বসানো হয়, এবং এরপর ১৪ সেপ্টেম্বর তা উৎক্ষেপণ করা হয়। উৎক্ষেপণের আগের ১২ দিন কচ্ছপদুটিকে সম্পূর্ণ না খাইয়ে রাখা হয়েছিল, যেন খাবারের কারণে কোনো শারীরিক পরিবর্তন না ঘটে এবং বিশুদ্ধ শারীরিক ডেটা সংগ্রহ করা যায়। কচ্ছপগুলোর সঙ্গে আরও ছিল কিছু মাছি, কীটপতঙ্গ, ব্যাকটেরিয়া, উদ্ভিদের বীজ এবং মানব কোষের নমুনা। মহাকাশযানটি চাঁদের চারপাশ দিয়ে প্রদক্ষিণ করে এবং কোনো অবতরণ ছাড়াই পৃথিবীর পথে ফিরে আসে। চার দিন পর অর্থাৎ ২১ সেপ্টেম্বর সেটি ভারত মহাসাগরে সফলভাবে অবতরণ করে এবং তখন দেখা যায় কচ্ছপদুটি জীবিত রয়েছে। যদিও তাদের শরীরের প্রায় ১০ শতাংশ ওজন হ্রাস পেয়েছিল, তবে অন্যান্য শারীরিক কার্যক্রম ছিল প্রায় স্বাভাবিক। গবেষণায় দেখা যায়, মহাকাশে ওজনহীনতা ও বিকিরণ শরীরের কিছু কার্যক্রমে সাময়িক প্রভাব ফেলে, কিন্তু কচ্ছপের মতো প্রাণী এই পরিস্থিতিও কিছুটা সহ্য করতে পারে। এই সফলতা সোভিয়েত বিজ্ঞানীদের জন্য ছিল এক বিরাট সাফল্য এবং ভবিষ্যতের ম্যানড স্পেস মিশনের ভিত্তিপ্রস্তর। Zond 5 এর এই মিশন মানুষের চন্দ্রাভিযানের এক ধাপ আগে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়। যদিও নাসার অ্যাপোলো ১১ মিশনে ১৯৬৯ সালের জুলাই মাসে নিল আর্মস্ট্রং চাঁদের মাটিতে পা রাখেন এবং বিশ্ববাসী তাক লাগিয়ে দেয়, তবুও চাঁদের আশেপাশে জীবন্ত প্রাণী নিয়ে ঘুরে আসার কৃতিত্ব প্রথম যায় সোভিয়েত ইউনিয়নের দখলে। এটি ছিল একটি প্রতীকী ও বৈজ্ঞানিক শক্তির প্রদর্শনী, যেখানে কচ্ছপদের সাহসী যাত্রার মধ্য দিয়েই মহাকাশে জীবনের উপস্থিতি নিয়ে গবেষণার নতুন অধ্যায় শুরু হয়। অনেকে ভাবতে পারেন কচ্ছপ কেন নির্বাচিত হয়েছিল এই মিশনের জন্য। তার কারণ হলো, কচ্ছপ অত্যন্ত ধৈর্যশীল ও টেকসই প্রাণী, যাদের বিপরীত পরিবেশে বেঁচে থাকার সক্ষমতা তুলনামূলকভাবে বেশি। তাদের দেহে পরিবর্তন ধীরে ঘটে, ফলে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পর্যবেক্ষণে বিজ্ঞানীরা পরিষ্কার ধারণা পেতে পারেন। Zond 5 মিশনের পর কচ্ছপদুটি ফিরিয়ে আনার পর তাদের শরীর, কোষ, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ইত্যাদি বিভিন্ন দিক থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয় এবং পাওয়া যায় গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল। মহাকাশে উচ্চ বিকিরণ ও ভারশূন্য পরিবেশ শরীরের জিন, প্রোটিন সিন্থেসিস ও কোষ বিভাজনের উপর কী রকম প্রভাব ফেলে তা নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করা হয়। এসব গবেষণার ভিত্তিতে ভবিষ্যতে মহাকাশচারীদের খাদ্যাভ্যাস, নিরাপত্তা, বায়োসুইট ডিজাইন ইত্যাদি সিদ্ধান্ত গ্রহণে সুবিধা হয়। Zond 5 মিশন চাঁদে অবতরণ না করলেও এটি ছিল মানববিহীন মিশনের দৃষ্টিকোণে এক বিশাল অগ্রগতি। এটি চাঁদের অন্ধকার দিকও ছবি তোলে এবং পৃথিবীর পৃষ্ঠে ফিরে আসার পর সফলভাবে পুনরুদ্ধার করা যায়। যেহেতু মহাকাশযানটি পৃথিবীর কক্ষপথে পুনরায় ঢোকার সময় উচ্চগতির সঙ্গে সংঘর্ষের ঝুঁকি থাকে, তাই পুরো অভিযান ছিল অত্যন্ত বিপজ্জনক। কিন্তু সব বাধা অতিক্রম করে কচ্ছপসহ এই জীবন্ত প্রাণীগুলো সফলভাবে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়। এটি ইতিহাসে প্রথম উদাহরণ যখন কোনো জীবন্ত প্রাণী চাঁদের কাছাকাছি গিয়ে আবার বেঁচে ফিরে এসেছে। অনেকেই মনে করেন, চাঁদ সম্পর্কিত ইতিহাস শুধু মানুষের পদার্পণের মধ্যে সীমাবদ্ধ, কিন্তু Zond 5 প্রমাণ করে যে প্রাণবিজ্ঞানের ইতিহাসেও এটি এক অনন্য ঘটনা। এই অভিযানের মাধ্যমে মহাকাশবিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন মহাকাশ ভ্রমণের সময় কিভাবে একটি জীবন্ত শরীর রক্ষা করা যায়, কোন ধরনের চ্যালেঞ্জ থাকে এবং ভবিষ্যতে কীভাবে সুরক্ষা প্রযুক্তি তৈরি করতে হবে। Zond 5 কচ্ছপদের মাধ্যমে যে তথ্য ও অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছিল তা পরবর্তীতে নাসা ও অন্যান্য মহাকাশ সংস্থার বহু গবেষণায় কাজে লাগে। এটি কেবলমাত্র একটি অভিযান ছিল না বরং ছিল প্রাণ, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির এক সম্মিলিত বিজয়গাথা। তাই ইতিহাসে যদি প্রথম চাঁদের বুকে মানুষের পা রাখার কাহিনি বীরত্বের হয়, তবে তার কিছু আগেই লেখা হয়েছিল আরও এক নিঃশব্দ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। যেখানে দুটি নিরীহ কচ্ছপ আমাদের জানিয়ে গিয়েছিল, প্রাণ নিয়ে মহাকাশে যাওয়া এবং ফিরে আসা সম্ভব।
– ইমরুল কায়েস





