জানার আছে অনেক কিছু

মাউন্ট ফুজি: জাপানের প্রতীক, প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ নিদর্শন

বিশ্বের অন্যতম সুন্দর, রহস্যময় এবং পূজনীয় পর্বতগুলোর মধ্যে একটি হলো মাউন্ট ফুজি। জাপানের মাঝখানে অবস্থিত এই আগ্নেয়গিরিটি শুধুমাত্র একটি ভৌগোলিক গঠন নয়, বরং জাপানের সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং জাতীয় চেতনার অবিচ্ছেদ্য অংশ। হাজার বছর ধরে এটি শিল্পী, কবি, দার্শনিক ও পর্যটকদের আকর্ষণ করে আসছে। আজ আমরা মাউন্ট ফুজির ইতিহাস, ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য, সাংস্কৃতিক গুরুত্ব এবং বর্তমান অবস্থা নিয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব। মাউন্ট ফুজি (Fuji-san) জাপানের সবচেয়ে উঁচু পর্বত, যার উচ্চতা ৩,৭৭৬ মিটার (১২,৩৮৯ ফুট)। এটি হোনশু দ্বীপে, টোকিও থেকে প্রায় ১০০ কিমি দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। মাউন্ট ফুজি একটি স্ট্র্যাটোভলকানো বা স্তরিত আগ্নেয়গিরি, যা তিনটি আগ্নেয়গিরির সংমিশ্রণ কোমিতাকে, কুডার এবং ফুজি। এটি এমনভাবে অবস্থিত যে পরিষ্কার দিনে টোকিও শহর থেকেও ফুজির চূড়া দৃশ্যমান হয়। এই পর্বতটি শিজুওকা ও ইয়ামানাশি প্রদেশের সীমান্তে অবস্থান করছে এবং জাপানের ঐতিহাসিক ‘ফুজি-হাকোনে-ইজু’ ন্যাশনাল পার্কের অংশ। মাউন্ট ফুজি কেবলমাত্র একটি প্রাকৃতিক দৃশ্য নয়, এটি জাপানের ধর্ম, কল্পনা ও সংস্কৃতির একটি গভীর প্রতীক। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জাপানের জনগণ এই পর্বতকে পবিত্র বলে মনে করে এসেছে। এটি শিন্টো এবং বৌদ্ধ ধর্মে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। শিন্টো বিশ্বাস অনুযায়ী, ফুজি হলো একটি দেবীর আবাস। ‘কোনোহানাসাকুয়া-হিমে’ নামে এক দেবীকে ফুজির আত্মা হিসেবে পূজা করা হয়। ফুজির চূড়ায় একটি শিন্টো মন্দিরও আছে যেখানে অনেকে তীর্থযাত্রায় যান। এছাড়াও, “ফুজি কো” নামে একটি ধর্মীয় সম্প্রদায় ছিল যারা ফুজিকে উপাসনার স্থান হিসেবে মানত এবং প্রতি বছর পায়ে হেঁটে পর্বতের চূড়ায়登山 (তোযান) করত।
জাপানি শিল্প ও সাহিত্যে মাউন্ট ফুজির এক বিশেষ স্থান রয়েছে। বিখ্যাত শিল্পী হোকুসাই এর “থার্টি-সিক্স ভিউস অফ মাউন্ট ফুজি” (Thirty-Six Views of Mount Fuji) চিত্রমালায় ফুজিকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করা হয়েছে। এই চিত্রশিল্পগুলো আজও বিশ্বব্যাপী পরিচিত এবং প্রশংসিত। কবিতা ও হাইকুতে ফুজি একটি বহুল ব্যবহৃত উপমা। জাপানি লেখকেরা বহু বছর ধরে ফুজিকে নিয়ে কবিতা ও গল্প লিখেছেন— কখনো প্রেমের প্রতীক, কখনো প্রকৃতির অসীম শক্তির নিদর্শন হিসেবে। মাউন্ট ফুজি একটি সুপ্ত আগ্নেয়গিরি (Dormant volcano)। সর্বশেষ অগ্নুৎপাত হয়েছিল ১৭০৭ সালে, যেটিকে “হোয়েই অগ্নুৎপাত” বলা হয়। এই অগ্ন্যুৎপাতের ফলে আশেপাশের অঞ্চল ছাইয়ে ঢেকে গিয়েছিল এবং টোকিও পর্যন্ত ধূলিকণা পৌঁছে গিয়েছিল। যদিও এটি দীর্ঘদিন অগ্নুৎপাতহীন অবস্থায় রয়েছে, বিজ্ঞানীরা এখনো এটি সক্রিয় আগ্নেয়গিরির তালিকায় রাখেন। ফুজি পর্বতের অভ্যন্তরে এখনো ম্যাগমার গতি-প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করা হয় এবং এটি পুনরায় অগ্নুৎপাত করতে পারে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। মাউন্ট ফুজি হলো জাপানের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য। প্রতিবছর লক্ষাধিক পর্যটক ও অভিযাত্রী ফুজি পর্বত আরোহনের উদ্দেশ্যে ভ্রমণ করেন। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ফুজি পর্বত আরোহনের জন্য উপযুক্ত সময়, কারণ এই সময়ে আবহাওয়া অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল ও নিরাপদ। পর্বত আরোহনের জন্য চারটি প্রধান পথ রয়েছে— ইয়োশিদা ট্রেইল, সুবাশিরি ট্রেইল, গোটেমবা ট্রেইল ও ফুজিনোমিয়া ট্রেইল। প্রতিটি ট্রেইলে ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতা মেলে এবং পথে পথে বিশ্রাম কেন্দ্র ও খাবারের দোকানও থাকে। চূড়ায় পৌঁছে সকালের সূর্যোদয় দেখা — “গোরািকো” — ফুজি আরোহনের অন্যতম মোক্ষম মুহূর্ত। বহু মানুষ এই অভিজ্ঞতার জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা করে।
২০১৩ সালে মাউন্ট ফুজিকে UNESCO এর বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায় স্থান দেওয়া হয় “Cultural Site” হিসেবে। এর মানে শুধু প্রকৃতির জন্য নয়, বরং এর ধর্মীয়, সাহিত্যিক ও নান্দনিক গুরুত্বের জন্য এই স্বীকৃতি। UNESCO এটিকে “বিশ্বব্যাপী অনুপ্রেরণার প্রতীক” হিসেবে ঘোষণা করে। এর আশেপাশের ২৫টি ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় স্থানকেও এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
মাউন্ট ফুজির চারপাশে অসাধারণ প্রাকৃতিক পরিবেশ রয়েছে। বনভূমি, হ্রদ, গরম পানির ঝর্ণা এবং বন্যপ্রাণে ভরপুর এলাকা এটি ঘিরে রেখেছে। ফুজি-ফাইভ-লেকস (Fuji Five Lakes) — কাওয়াগুচি, সাই, শোজি, মোতোসু এবং ইয়ামানাকা হ্রদ — পর্বতের সৌন্দর্যকে আরো বহুগুণ বাড়িয়ে তোলে। তবে, পর্যটকদের ভিড়ে ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে পরিবেশগত ভারসাম্য কিছুটা হুমকির মুখে পড়ছে। স্থানীয় প্রশাসন ও জাপান সরকার এই ঐতিহ্য রক্ষায় নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে, যেমন— ট্রেইলে নিয়ন্ত্রণ, আবর্জনা ব্যবস্থাপনা ও শিক্ষা কার্যক্রম। মাউন্ট ফুজি কেবলমাত্র একটি পাহাড় নয়; এটি একটি জাতির আত্মার প্রতিচ্ছবি। জাপানি জনগণের মনে, সাহিত্যে, ধর্মে ও শিল্পে এটি রয়ে গেছে এক অমর প্রতীক হয়ে। এটি একাধারে প্রাকৃতিক শক্তির প্রতীক, আবার মানব আত্মার উচ্চতাকেও প্রতিফলিত করে। আজকের দ্রুত পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে মাউন্ট ফুজি আমাদের মনে করিয়ে দেয় প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের গভীর সংযোগের কথা, শ্রদ্ধা ও সমতার প্রয়োজনীয়তা, এবং সেই শাশ্বত সৌন্দর্যের কথা, যা যুগ যুগ ধরে মানবজাতিকে আলোড়িত করে এসেছে।
– ইমরুল কায়েস