বর্তমান সময়ে তরুণ সমাজের মধ্যে একটি অদৃশ্য যন্ত্রণা দিনদিন বেড়ে চলেছে—তা হলো নিজেকে অযোগ্য, ব্যর্থ বা হেয় মনে করা। এই অনুভূতি আসে সমাজ, পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা আশপাশের মানুষের আচরণ থেকে। মানুষ যখন বারবার তুচ্ছতাচ্ছিল্যের মুখে পড়ে, যখন তার চেষ্টা ও অবস্থাকে গুরুত্ব না দিয়ে কেবল ফলাফল দিয়ে বিচার করা হয়, তখন সে ধীরে ধীরে নিজের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। এভাবে জন্ম নেয় আত্মগ্লানি, মানসিক চাপ, এবং এক ধরণের ভেতর থেকে মরে যাওয়া অনুভূতি।
অনেক পরিবারে প্রতিদিন শোনা যায়, “তুমি কিছু করছো না?”, “আর কতদিন বসে থাকবে?”, “অমুক তো এত কিছু করছে, তুমি পারছো না কেন?”—এ ধরনের কথা কেউ হয়তো ভালো চেয়ে বলে, কিন্তু অনেক সময় তা তরুণ-তরুণীদের মনে গভীর আঘাত করে। কেউ হয়তো নিজের মতো চেষ্টা করছে, কিন্তু সফল হতে সময় লাগছে; কেউ মানসিকভাবে ভালো নেই, আবার কেউ তার জীবনপথ খুঁজে চলেছে। কিন্তু পরিবার যদি প্রতিনিয়ত উপেক্ষা করে, তুলনা করে, কিংবা হেয় করে, তখন একসময় মানুষ নিজেকেই তুচ্ছ ভাবতে শুরু করে। তার মধ্যে জন্ম নেয় এক ধরণের হীনমন্যতা—যা তাকে ভেতর থেকে গিলে খায়।
এই হীনমন্যতার পেছনে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ আছে। বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক সমাজে সফলতাই যেন মানুষের মূল্য নির্ধারণ করে। কিন্তু সফলতা সবার এক রকম হয় না। কেউ আগে পায়, কেউ পরে। আবার কেউ নিজেকে প্রকাশ করতে পারে না পরিবারের সামনে, ভয়ে, সংকোচে বা আস্থার অভাবে। প্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও এক ধরনের চাপ তৈরি করে। অন্যের জীবন দেখে মনে হয়, “আমি পিছিয়ে আছি, আমার কিছুই নেই।”
এই অনুভূতি যখন পরিবারের তুচ্ছ কথা ও দৃষ্টির সঙ্গে মিলিত হয়, তখন মানুষ নিজের মধ্যেই হারিয়ে যায়।
এভাবে চলতে থাকলে মানসিক চাপ, উদ্বেগ, অবসাদ এমনকি আত্মহত্যার মতো চিন্তাও মাথায় আসতে পারে। অথচ মানুষ তো ভুল করতে পারে, সময় নিতে পারে, আবার থেমে যেতেও পারে — সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সমাজ ও পরিবার আমাদের শেখায়, “চলতেই হবে, করতেই হবে, পারতেই হবে।” এই দৃষ্টিভঙ্গি না বদলালে, শুধু আরও ভেঙে পড়া তরুণ প্রজন্ম পাবো আমরা।
তবে এই কঠিন সময়েও কিছু করণীয় আছে, যা মানুষকে নিজের প্রতি বিশ্বাস ফিরিয়ে দিতে পারে। প্রথমত, নিজেকে হেয় ভাবা বন্ধ করতে হবে। আমি যা পারি না, তার মানে এই না যে আমি অকেজো। আমার পথ হয়তো আলাদা, আমার সময় একটু বেশি লাগছে, তাতে সমস্যা নেই। নিজেকে সময় দেওয়া, ভালোবাসা দেওয়া ও বোঝা অত্যন্ত জরুরি। দ্বিতীয়ত, পরিবারের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা উচিত—নিজের অবস্থা বোঝানোর জন্য। যদি কেউ না বোঝে, তবুও নিজের জন্য সাহস রাখতে হবে। তৃতীয়ত, মানসিক চাপ থেকে মুক্তির জন্য শারীরিক যত্ন, পর্যাপ্ত ঘুম, ব্যায়াম, প্রার্থনা বা মেডিটেশনের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। কাউকে বিশ্বাস করে মন খুলে বলা, বন্ধু বা কাউন্সেলরের সাহায্য নেওয়া অনেক উপকারে আসতে পারে।
সবচেয়ে বড় কথা হলো—তুমি যথেষ্ট।
তুমি যা করছো, যেভাবে করছো, নিজের মতো করেই করছো—এইটাই অনেক। সফলতা সময় সাপেক্ষ, কিন্তু আত্মসম্মান তাৎক্ষণিক প্রয়োজন। তাই নিজেকে হেয় ভাবা নয়, নিজেকে বোঝা এবং ভালোবাসাই হওয়া উচিত জীবনের মূল চাবিকাঠি।
-লাল ঠিয়াত জুয়াল বম





