সাম্প্রতিক খবর সাহিত্য সংস্কৃতি

শুভ জন্মদিন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম।

আজ ২৪ মে, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর ১২৬ তম জন্মবার্ষিকী। বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য নাম কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি শুধু একজন কবি নন, ছিলেন একাধারে সংগীতজ্ঞ, গীতিকার, নাট্যকার, গল্পকার, সাংবাদিক, এবং সর্বোপরি এক প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। তার জীবন, সাহিত্য ও সংগীত আমাদের জাতীয় চেতনাকে উদ্বুদ্ধ করেছে, মুক্তির জন্য প্রেরণা জুগিয়েছে। নজরুল ছিলেন বাঙালির বিদ্রোহী আত্মার প্রতীক, যিনি শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন এবং কলমকে বানিয়েছিলেন অস্ত্র। কাজী নজরুল ইসলাম জন্মগ্রহণ করেন ১৮৯৯ সালের ২৪ মে, পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে। তার পিতার নাম কাজী ফকির আহমদ এবং মাতার নাম জাহেদা খাতুন। পরিবারের আর্থিক অবস্থা স্বচ্ছল ছিল না। ছোটবেলায় পিতার মৃত্যু হলে নজরুলের ওপর নেমে আসে সংসারের ভার। অল্পবয়সে লেটো গানের দলে কাজ শুরু করেন। এরপর মসজিদের মুয়াজ্জিন হিসেবেও কাজ করেছেন। জীবনের এসব অভিজ্ঞতা তার সৃষ্টিশীলতায় গভীর প্রভাব ফেলেছিল। নজরুল ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং ৪৯তম বেঙ্গল রেজিমেন্টে কাজ করেন। সেখানে তিনি প্রায় তিন বছর ছিলেন। সেনাবাহিনীতে থাকা অবস্থায় তিনি ইংরেজি, ফারসি ও আরবি ভাষা শিখেছিলেন এবং সাহিত্যচর্চা অব্যাহত রেখেছিলেন। এই সময়ে তার কবিতায় যুদ্ধ, সংগ্রাম ও বিদ্রোহের চেতনা প্রবলভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। ১৯২২ সালে নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশিত হলে সাহিত্য অঙ্গনে এক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। “বিদ্রোহী” কবিতাটি তাকে এনে দেয় “বিদ্রোহী কবি” উপাধি। তিনি বলেন:

“আমি চিরবিদ্রোহী বীর —
বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!”

তার সাহিত্য শুধুমাত্র কাব্যিক সৌন্দর্যে নয়, সমাজ পরিবর্তনের স্পষ্ট আহ্বানে পরিপূর্ণ। তার কবিতা, গান ও গদ্যরচনায় ফুটে উঠেছে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য, নারীর অধিকার, সাম্যবাদ, মানবতা ও শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্ন। নজরুল ইসলাম সমাজে বিদ্যমান শ্রেণি-বৈষম্য, সাম্প্রদায়িকতা, কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। “সাম্যবাদী” কবিতায় তিনি ঘোষণা করেন:

“আমি সেই মুহাম্মদ, আমি সেই রাম
আমি খ্রিস্ট, বুদ্ধ, আমি কালের যাম!”

তিনি বিশ্বাস করতেন, ধর্ম মানুষের কল্যাণে, শাসনে নয়। তার গানে ও লেখায় বারবার ফিরে এসেছে ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নেই’ এই বার্তা।
নজরুল একাধারে প্রায় ৪,০০০ এর বেশি গান রচনা ও সুর করেছেন, যা আজও বাঙালির হৃদয়ে গেঁথে আছে। তার সংগীতকে “নজরুল সঙ্গীত” নামে অভিহিত করা হয়। তার গানে প্রেম, বিরহ, দেশপ্রেম, বিদ্রোহ এবং মানবতার কথা আছে। ইসলামি সংগীত যেমন “নামাজ আমার নয়টি রাকাত”, তেমনই শ্যামাসঙ্গীত বা কীর্তনধর্মী গানও রয়েছে , যা বাঙালির বহুত্ববাদী সংস্কৃতির নিদর্শন। নজরুল “ধুমকেতু” নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন, যেখানে তিনি বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। ১৯২৩ সালে তাঁর একটি প্রবন্ধের জন্য তাকে গ্রেফতার করা হয়। জেলে বসে তিনি লেখেন “রাজবন্দীর জবানবন্দি”, এবং বহু কবিতা ও গান রচনা করেন, যার মধ্যে অন্যতম “অগ্নিবীণা” কাব্যগ্রন্থ। নজরুল ছিলেন নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার সাহসী কণ্ঠ। তিনি নারীর অবস্থানকে পুরুষের সমকক্ষ দেখতে চাইতেন। তার কবিতায় নারীর রূপ শুধু রোমান্টিক নয়, ছিল সংগ্রামীও। তিনি বলেন:

“বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।”

কিন্তু মাত্র ৪৩ বছর বয়েসে ১৯৪২ সালে নজরুল এক অজানা অসুস্থতায় আক্রান্ত হন, যা পরে “পিকস ডিজিজ” হিসেবে চিহ্নিত হয়। এই অসুস্থতা তার বাকশক্তি কেড়ে নেয়। ফলে সমাপ্তি ঘটে তাঁর সাহিত্য যাত্রার। দীর্ঘ ৩৪ বছর তিনি নির্বাক জীবন কাটান। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার নজরুলকে ঢাকা নিয়ে আসে। তাকে “জাতীয় কবি” উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট তিনি ঢাকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়। নজরুল ইসলাম শুধু সাহিত্যিক বা সংগীতজ্ঞ নন, তিনি এক চেতনার নাম। তার কবিতা ও গান আজও আমাদের মুক্তির পথ দেখায়। বিশেষ করে যে সময়ে সমাজে বিভেদ ও ঘৃণার রাজনীতি দেখা যায়, সেই সময়ে নজরুলের অসাম্প্রদায়িক দর্শন, তার মানবতাবাদী চেতনা আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক ও দিশাদর্শী। তার সাহিত্য, গান ও জীবন সংগ্রাম আমাদের শিখায়, কিভাবে প্রতিবাদ করতে হয়, কিভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়, কিভাবে ভালোবাসা ও সাম্যের সমাজ গড়ে তুলতে হয়। নজরুলের কণ্ঠে ছিল এক আগুনের ধ্বনি — যা আজও আমাদের হৃদয়কে উদ্দীপ্ত করে।
– ইমরুল কায়েস