সময়টা ছিল ১৯৮৪ সাল, এক শীতের রাতে আলাস্কার ফেয়ারব্যাঙ্কস শহরে জীবাশ্মবিদ ডেল গথ্রির বাড়িতে জড়ো কয়েকজন অতিথি। তাদের রাতের খাবার এর আয়োজন এ ছিল বিশাল চমক।স্টুতে রান্না হচ্ছিল ব্লু বেব নামে পরিচিত এক প্রাগৈতিহাসিক বাইসনের মাংস, যার বয়স আজ অন্তত ৫০ হাজার বছর। আলাস্কান রীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই ডিনার ছিল একেবারে স্থানীয় শিকারের ঐতিহ্য অনুসারে। কেননা রাজ্যের আইনে বন্যপ্রাণীর মাংস কেনাবেচা নিষিদ্ধ, ফলে এই জাতীয় খাবার কেবলমাত্র শিকারিদের পারিবারিক আড্ডায় উপভোগ করা যায়। তবে ব্লু বেব ছিল এক ব্যতিক্রম। এটি শুধু শিকার নয়, ছিল একটি যুগান্তকারী বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার। ১৯৭৯ সালে সোনার খনির শ্রমিকরা যখন তাদের খনির কাজ করছিলেন, হঠাৎ হাইড্রোলিক হোসের পানির প্রবাহ বরফ গলিয়ে বের করে আনে এই জমাট বাঁধা প্রাণীর দেহাবশেষ। খবর পৌঁছায় ইউনিভার্সিটি অফ আলাস্কা ফেয়ারব্যাঙ্কসে। অধ্যাপক গথ্রি শঙ্কিত হন, মাটি থেকে বের হলে দেহটি পচে যাবে। তাই বরফের বাধা অতিক্রম করে তিনি যতটুকু সম্ভব দেহাংশ কাটেন এবং সংরক্ষণ করেন। পরবর্তীতে গবেষণায় দেখা যায়, ব্লু বেব সম্ভবত বরফ যুগের বিশাল গুহা-সিংহ এর শিকার হয়েছিল। বিস্ময়করভাবে, মৃত্যুর পর বাইসনটি এত দ্রুত বরফে জমে গিয়েছিল যে তার পেশির গঠন, চর্বি এবং অস্থিমজ্জা হাজার হাজার বছর পরও প্রায় অক্ষত ছিল। গবেষকরা তখন ভাবলেন — ইতিহাস পড়া হয়েছে, দেখা হয়েছে, এবার স্বাদ নেওয়া যাক। গথ্রি বলেন, তারা আগে থেকেই শুনেছিলেন রাশিয়ান বিজ্ঞানীরা বরফে জমে থাকা ম্যামথ এবং বাইসনের মাংস খেয়ে দেখেছেন। এই ধারণা থেকেই তারা ঠিক করেন, ব্লু বেবের মাংসের একটি অংশ দিয়ে স্টু রান্না করা হবে। যখন ট্যাক্সিডারমিস্ট এরিক গ্রাঙ্কভিস্ট ব্লু বেবের পুনর্গঠন কাজ সম্পন্ন করেন, তখনই আয়োজন করা হয় এই ডিনার। উপস্থিত ছিলেন জীবাশ্মবিজ্ঞানী বিয়র্ন কার্টেনও। ডিনারের জন্য ব্লু বেবের গলদেশের একটি ছোট টুকরো কাটা হয়। গলানোর পর তা গরুর মাংসের মতো সুগন্ধ ছড়ায়, সামান্য মাটির গন্ধ আর মাশরুমের আভাস ছিল তাতে। রান্নায় ব্যবহার হয় রসুন, পেঁয়াজ, গাজর, আলু আর বেশ ভালো মানের ওয়াইন। সব মিশে তৈরি হয় সেই ঐতিহাসিক স্টু, যার স্বাদ গথ্রির ভাষায় , “সামান্য কাদার গন্ধ থাকলেও, খারাপ ছিল না। এতটা খারাপ নয় যে আমরা খেতে পারিনি। তবে কেউ দ্বিতীয়বার নিয়েছিল কিনা, সেটা মনে নেই।” গথ্রি বলেন, তিনি মাংসের প্রাচীনতা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন না। বরং, শিকারি হিসেবে তার অভ্যাস পুরোনো মাংস খাওয়ার। তিনি বলেন, “মাইক্রোবায়োলজিক্যালভাবে এতে অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল খুবই কম।” আজও ব্লু বেব সংরক্ষিত আছে ইউনিভার্সিটি অফ আলাস্কার মিউজিয়াম অফ দ্য নর্থ-এ, যেখানে দর্শনার্থীরা এসে দেখে এই বরফযুগের আশ্চর্য জীবের দেহাবশেষ এবং সেই সময়ের পরিবেশের ছবি।তাই, ইতিহাসের পাতায় এই ডিনার শুধু কৌতূহলের বিষয় নয়, বরং স্মরণীয় এক বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক মুহূর্ত। আর আমাদের জন্যও এক বার্তা রেখে যায় — চার বছরের পুরোনো আচার খেতে অস্বীকার করার আগে, একবার ভাবুন তো সেই ৫০ হাজার বছরের পুরোনো ব্লু বেব স্টুর কথা!
– ইমরুল কায়েস





