একটা সময় ছিল যখন যোগাযোগ বলতে বোঝানো হতো হাতে লেখা চিঠি, ডাকপিয়নের অপেক্ষা আর ডাকবাক্সে জমা থাকা ভালোবাসার বার্তা। রাজাদের রাষ্ট্রীয় বার্তা আদান-প্রদান থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেওয়ার মাধ্যম ছিল এই চিঠি। সময়ের পরিক্রমায় প্রযুক্তির ছোঁয়ায় চিঠি লেখা আজ বিলুপ্তির পথে,প্রযুক্তির অগ্রযাত্রায় সেই ডাকবাক্স আজ প্রায় অব্যবহৃত, আর চিঠি লেখা যেন এক স্মৃতিকথায় পরিণত হয়েছে। তবুও এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব আজও অম্লান।
চিঠি আদান-প্রদানের প্রথা বহু পুরোনো। প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় প্রায় ৪০০০ বছর আগে চিঠির প্রচলন দেখা যায়, যেখানে প্যাপিরাসে বার্তা লেখা হতো। চীনে হান সাম্রাজ্যের সময় ডাকব্যবস্থার বিকাশ ঘটে এবং সরকারি কাজে চিঠি ব্যবহারের রীতি গড়ে ওঠে। রোমান সাম্রাজ্যে সুরক্ষিত বার্তা পরিবহনের জন্য কুরিয়ার ব্যবস্থার প্রচলন ছিল, যা পরবর্তীতে ইউরোপের অন্যান্য অংশেও ছড়িয়ে পড়ে।
ভারতবর্ষে মৌর্য সাম্রাজ্যের (খ্রিস্টপূর্ব ৩২১-১৮৫) সময় থেকে ডাক ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল। সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসনামলে দূতরা ঘোড়ায় চড়ে বার্তা পৌঁছে দিত। মোগল আমলে ডাক ব্যবস্থা আরও সুসংগঠিত হয়, যেখানে অশ্বারোহী ও পদাতিক ডাকবাহকদের মাধ্যমে রাজ্যজুড়ে বার্তা আদান-প্রদান করা হতো।
ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশে আনুষ্ঠানিক ডাকব্যবস্থার সূচনা ঘটে। ১৭৬৬ সালে ব্রিটিশরা প্রথম ডাকব্যবস্থা চালু করে এবং ১৮৫৪ সালে আধুনিক ডাকটিকিট প্রবর্তন করে। শহর ও গ্রামে ডাকবাক্স স্থাপন করা হয়, যেখানে সাধারণ মানুষ চিঠি পোস্ট করতে পারত। ঘোগড়ার গাড়ি, স্টিমার ও পরবর্তীতে রেলগাড়ির মাধ্যমে ডাক পরিবহন আরও গতিশীল হয়।
সুনির্মল বসুর “রানার” কবিতায় চিঠি পরিবহনের কঠোর বাস্তবতা ফুটে উঠেছে। সেই রানার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছুটত, বৃষ্টিতে ভিজত, ঝড়ে পথ হারাত—তবু তার গন্তব্যে পৌঁছানোর এক অদম্য শক্তি ছিল। আজ প্রযুক্তির কারণে সেই দৃশ্য হারিয়ে গেছে।প্রযুক্তির কারণে চিঠির ব্যবহার অনেক কমে গেছে। মোবাইল, ইমেইল, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে মানুষ সহজেই যোগাযোগ করতে পারে। ফলে ডাকবাক্স ফাঁকা পড়ে থাকে, আর রানার বা ডাকপিয়নের গুরুত্ব হারিয়ে গেছে।
তবে এখনও কিছু ক্ষেত্রে ডাকব্যবস্থার প্রয়োজন রয়েছে—
✔ সরকারি ও আইনি নথি (আদালতের চিঠি, সরকারি নির্দেশনা)
✔ ব্যবসায়িক যোগাযোগ (ব্যাংক স্টেটমেন্ট, চুক্তিপত্র)
✔ পার্সেল ও ডাকসেবা (বই, আমন্ত্রণপত্র, অফিসিয়াল নথি
যদিও চিঠি লেখা আজ কমে এসেছে, তবু চিঠির প্রতি মানুষের ভালোবাসা মুছে যায়নি। অনেকেই এখনো হাতে লেখা চিঠির গন্ধ, অনুভূতি আর অপেক্ষার রোমাঞ্চকে স্মরণ করে। প্রেমপত্র, মায়ের লেখা চিঠি, বন্ধুর দূরদেশ থেকে পাঠানো সংবাদ—এসব কিছুই ছিল এক অমূল্য স্মৃতি। অনেকে আজও পুরোনো চিঠি জমিয়ে রাখে, কখনো কখনো হয়তো তা খুলে পড়ে পুরোনো দিনগুলোর ছোঁয়া খোঁজে।
প্রযুক্তির সহজলভ্যতার পরও মানুষের মনে কোথাও না কোথাও পুরোনো চিঠির জন্য এক ধরনের অপূর্ণতা কাজ করে। কারণ ডিজিটাল বার্তাগুলো দ্রুত আসে, দ্রুত মিলিয়ে যায়। কিন্তু হাতে লেখা চিঠি একটা স্থায়ী স্মৃতি হয়ে থাকে। তাই আজও কিছু মানুষ চায়, ডাকব্যবস্থা যেন পুরোপুরি হারিয়ে না যায়। বিশেষ করে সাহিত্যপ্রেমী, ভিনটেজ ভালোবাসেন এমন মানুষ, কিংবা যাঁরা অনুভূতির গভীরতা বোঝেন—তাঁরা এখনো চিঠির চিরায়ত আবেদন টিকিয়ে রাখতে চান।চিঠি কেবল কাগজের টুকরো নয়, এটি সময়ের সাক্ষী, অনুভূতির বাহক। সময় বদলেছে, যোগাযোগের মাধ্যম বদলেছে, কিন্তু মানুষের আবেগ বদলায়নি। তাই হয়তো ডাকবাক্সের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক বৃদ্ধ আজও আশা করেন, কোনো একদিন তার নামে হয়তো একটা চিঠি আসবে—যেখানে থাকবে পুরোনো দিনের সেই হারিয়ে যাওয়া অনুভূতি, যেটা কোনো ইমেইল বা মেসেজ কখনো দিতে পারবে না।
– অংকিতা রায় চৌধুরী





