আমাদের সবচেয়ে পরিচিত মাদক হচ্ছে ধূমপান। তামাক গাছের পাতা ও ডাল শুকিয়ে তামাক তৈরি হয়। শুকনা তামাকপাতা কুচি কুচি করে কেটে তাকে বিশেষ কাগজে মুড়িয়ে সিগারেট এবং পাতায় মুড়িয়ে বিড়ি ও চুরুট বানানো হয়। এগুলোকে পুড়িয়ে তার ধোঁয়া ও বাষ্প সেবনকে ধূমপান বলে। সুতরাং ধূমপান বলতে সিগারেটের মধ্যে থাকা পোড়া তামাক থেকে উৎপন্ন ধোঁয়ার শ্বাস নেওয়াকে বোঝায়। এটা সবাই স্বীকার করে যে ধূমপান একটি খারাপ অভ্যাস।
এটি একজন ধূমপায়ীকে কিছুই দেয় না কিন্তু ধীরে ধীরে তাকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়। লোকেরা এই ভেবে ধূমপান করে যে ধূমপান করলে চিন্তা মুক্ত হওয়া যায়, চাপ বা প্রেশার রিলিজ। তারা আরও মনে করেন, ধূমপান স্মার্টনেস বাড়ায়। আদতে এর কিছুই নয়, আসলে এটি মজা করার একটি উপায় হিসাবে শুরু হয় কিন্তু একটি আসক্তি হিসাবে শেষ হয় যা ছেড়ে দেওয়া এত কঠিন।
ধূমপান ধূমপায়ীকে খুব বিপজ্জনকভাবে প্রভাবিত করে। এটি ক্যান্সার, হৃদরোগ, ব্রঙ্কাইটিস ইত্যাদির মতো অনেক মারাত্মক রোগের সূত্রপাত করে। তামাকের নিকোটিন জিনের মাধ্যমে রক্তের অবাধ সঞ্চালনকে খারাপ ভাবে ব্যাহত করে। এটি শরীরে অক্সিজেনের সরবরাহকে বাধাগ্রস্থ করে এবং ধূমপায়ীর ফুসফুসের ক্ষতি করে। ধূমপান চোখ জ্বালা করে, নাক খারাপ করে এবং মনকে অস্থির করে। ধূমপানের কারণে ধূমপায়ীর বার্ধক্যজনিত রোগ হয়। এটি জীবনের দীর্ঘায়ু হ্রাস করে। এটি অর্থের অপচয়ের সূত্রপাত করে। তাছাড়া পরোক্ষ ধূমপানের প্রভাবে অধূমপায়ীর জীবনকেও ঝুঁকির মুখে ফেলে একজন ধূমপায়ী।
প্রতিবছর শুধু ধূমপানের কারণে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করে। এক গবেষণায় দেখা গেছে পুরুষ ও মহিলা ধূমপায়ী গড়ে তাদের জীবনের যথাক্রমে ১৩.২ ও ১৪.৫ বছর হারান। অপর এক গবেষণায় ৬.৮ বছরের কথা বলা হচ্ছে। বলা হয়ে থাকে একটি সিগারেট গড়ে প্রায় এগারো মিনিট আয়ু কমিয়ে দেয়। সারা জীবন ধূমপানকারীদের মধ্যে কমপক্ষে অর্ধেক ধূমপানের ক্ষতির কারণে মারা যায়। অধূমপায়ীর তুলনায় একজন ধূমপায়ীর ৬০ বা ৭০ বছর বয়সের পূর্বে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় তিনগুণ।
১৯৩০ সালে জার্মান বিজ্ঞানীগণ দেখান যে সিগারেট ফুসফুস ক্যান্সার করতে পারে। ১৯৩৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীগণ মানুষের জীবনকাল ও ধূমপানের মধ্যে একটি নেতিবাচক সম্পর্ক খুঁজে পান। ১৯৫০ সালে পাঁচটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় যার প্রত্যেকটিতে ফুসফুস ক্যান্সারের সাথে ধূমপানের শক্তিশালী সম্পর্ক দেখানো হয়। এই গবেষণার ফলগুলো ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে স্মোকিং অ্যান্ড কার্সিনোমা অব লাং শিরোনামে প্রকাশিত হয়।
উক্ত প্রতিবেদনে দাবি করা হয় যে, যারা েবশি পরিমাণে ধূমপান করে তাদের ফুসফুস ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা অধূমপায়ীদের তুলনায় পঞ্চাশ গুণ বেশি। ধূমপায়ী বলতে যারা দৈনিক ধূমপান করে তাদের বুঝানো হয়েছে এবং ধূমপান সংক্রান্ত সকল গবেষণায় এই ক্যাটাগরিকে ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়েছে। যারা দৈনিক ধূমপান করে না তাদেরকে অকেশনাল স্মোকার হিসেবে ধরা হয়। ২০০৬ সালে ইউরোপীয় গবেষণায় দেখা যায় এই ধরনের ধূমপায়ীদের ক্ষেত্রে ক্যান্সারের সম্ভাবনা অধূমপায়ীদের তুলনায় ১.২৪ গুণ বেশি। প্রত্যক্ষভাবে ধূমপানের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে বিস্তর আলোচনার মাঝে প্রায়ই পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হওয়ার বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার “বিশ্বজুড়ে মহামারী ২০০৯” প্রতিবেদনে বলা হয়েছে “ধূমপানজনিত কারণে প্রতি ১০টি মৃত্যুর ঘটে পরোক্ষ ধূমপানের প্রভাবে”। যারা ধূমপান করেন তারা শুধু নিজেদের নয় তাদের আশেপাশে যারা থাকে বিশেষ করে শিশুদের ক্ষতি করে। বাংলাদেশের পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষতিকর প্রভাব বিশেষ করে শিশুদের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে । একটি পরিসংখ্যান বলছে বাংলাদেশের শিশুদের এ্যাজমার ২৩ শতাংশ, শ্বাসকষ্টের নিচের অংশের সংক্রমণের ৩৫ শতাংশ আর কানের সংক্রমণের ৩৯ শতাংশ দেখা দেয় পরোক্ষ ধূমপানের প্রভাবে। বাংলাদেশের ৪০ শতাংশেরও বেশি শিশু বাড়িতেই নিয়মিত পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছে। সবশেষে বলা যায়, ক্ষতি ছাড়া ধূমপানের কোনো উপকার নেই। ধূমপান ছাড়ুন আজই। জীবন সুন্দর। সুন্দর জীবনের সমাপ্তি তাড়াতাড়ি না হোক।
– মোহাম্মদ জাহিদ, নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি।





